ভূমিকা
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বারিশাল আবারো শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মাধ্যমে জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। বারিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন, যার পেছনে প্রধান কারণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে, যা একপর্যায়ে রাস্তায় নামার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বারিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে তারা দাবি তুলেছেন নিরপেক্ষ তদন্ত ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার।
ঘটনার পটভূমি
এই বিক্ষোভের সূচনা হয় বারিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে দায়ের করা জিডিকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পূর্ব ঘোষণা বা তদন্ত ছাড়াই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশে সাধারণ ডায়েরি করে, যা শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যায় ও উদ্দেশ্যমূলক বলে বিবেচিত হয়। ফলে সহপাঠীর নিরাপত্তা এবং ছাত্রদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এই জিডির মাধ্যমে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। তাদের মতে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং চলমান একটি দমননীতির অংশ।
বিক্ষোভের রূপ ও কর্মসূচি
বিক্ষোভ শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে সমাবেশের মাধ্যমে। এরপর শিক্ষার্থীরা সংগঠিতভাবে বারিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে অবস্থান নেন এবং যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এই অবরোধের ফলে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। তবে শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করছেন এবং প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বিক্ষোভে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, যেখানে লেখা ছিল "ছাত্র নির্যাতনের প্রতিবাদে একসাথে", "মিথ্যা জিডি প্রত্যাহার কর", এবং "ছাত্র রাজনীতি নয়, ছাত্র অধিকার চাই"।
শিক্ষার্থীদের দাবি
শিক্ষার্থীরা পাঁচটি মূল দাবি উত্থাপন করেন:
-
অভিযুক্ত সহপাঠীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সাধারণ ডায়েরি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
-
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
-
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষার্থীকে পূর্বঘোষণা ছাড়া পুলিশি হয়রানি বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।
-
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ছাত্রদের মৌলিক অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
-
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমদিকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও, পরে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য বলেন যে জিডি একটি "প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা" হিসেবে করা হয়েছিল যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বজায় থাকে। তবে প্রশাসনের এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয় এবং আন্দোলন আরও জোরদার হয়।
এক পর্যায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলকে ডাকা হয়, তবে শিক্ষার্থীরা জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত তারা কর্মসূচি থেকে পিছপা হবেন না।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাবেক শিক্ষার্থীরা, মানবাধিকারকর্মীরা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এই ঘটনার নিন্দা জানান। কেউ কেউ বলেন, এটি বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে "দমনমূলক প্রশাসনিক সংস্কৃতির একটি দৃষ্টান্ত"।
একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ভূমিকা নিচ্ছে, তা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে।”
জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া ও ভোগান্তি
মহাসড়ক অবরোধের ফলে অনেক যাত্রী দীর্ঘ সময় আটকে থাকেন এবং জরুরি সেবাও ব্যাহত হয়। বিশেষ করে, দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও মালবাহী ট্রাকগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে পড়ে। যাত্রীরা প্রথমে ক্ষুব্ধ হলেও আন্দোলনের প্রকৃত কারণ জানতে পেরে অনেকেই শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
উপসংহার
বারিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কেবল একটি সাধারণ জিডির বিরুদ্ধে নয়; এটি একটি বৃহৎ আন্দোলনের প্রতিফলন, যেখানে ছাত্ররা তাদের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় নেমেছে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন বিক্ষোভ নতুন কিছু নয়, তবে এই ঘটনা প্রশাসনের স্বচ্ছতা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতার প্রশ্ন আবারো সামনে এনেছে।
এই আন্দোলন যদি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হয়, তাহলে তা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই এখন সময় এসেছে প্রশাসন এবং সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা এবং গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা—যাতে বিশ্ববিদ্যালয় আবার একটি জ্ঞানচর্চার নিরাপদ কেন্দ্র হিসেবে ফিরে আসতে পারে।
0 Comments