ভূমিকা
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশের কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জনমনে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত গ্রেপ্তার, হয়রানি, হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ প্রায়শই উঠে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, এবং কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে “পুলিশ কমিশন” গঠনের আহ্বান এসেছে। তাদের দাবি, পুলিশের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং বাহিনীর সংস্কার আনতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পুলিশ কমিশন গঠন জরুরি।
পুলিশ কমিশন কী এবং কেন প্রয়োজন?
পুলিশ কমিশন হলো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যার কাজ হবে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ, তদন্ত, মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান। এই কমিশন:
-
পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করবে
-
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে
-
বাহিনীর কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে সংস্কারের প্রস্তাব দেবে
-
নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনবে
-
জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক উন্নয়নের পথ নির্দেশ করবে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে পুলিশ প্রায়শই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নিরপেক্ষতা হারায়, সেখানে একটি স্বাধীন কমিশন সত্যিকার অর্থে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে কার্যকর হতে পারে।
বর্তমান বাস্তবতা ও অভিযোগের চিত্র
বাংলাদেশে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে:
-
রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘ঘর থেকে তুলে নেওয়া’
-
হেফাজতে মৃত্যু
-
মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো
-
জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন না দেওয়া
-
গণমাধ্যমকর্মীদের হেনস্থা
-
বিরোধীদলীয় কর্মসূচি দমন করতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ
এসব অভিযোগে বহুবার উচ্চ আদালতও মন্তব্য করেছে যে, পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও জনবান্ধব করতে হবে।
সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকা
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন যেমন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ALRD), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK), এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) বহুবার পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। TIB এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, “জনগণ মনে করে পুলিশ হচ্ছে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান।” এই চিত্র শুধুমাত্র ক্ষোভ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার প্রতিচ্ছবি।
এ কারণেই তারা দীর্ঘদিন ধরেই একটি "পুলিশ রিফর্ম কমিশন" গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের মতে, একমাত্র একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোই পারে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ইতোমধ্যেই পুলিশ কমিশন কার্যকরভাবে কাজ করছে। যেমন:
-
ভারত: বেশ কয়েকটি রাজ্যে পুলিশ কমিশন রয়েছে যারা পুলিশি অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্ত করে।
-
যুক্তরাজ্য: পুলিশের স্বাধীন তদন্ত সংস্থা (IPCC) পুলিশি সহিংসতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে।
-
দক্ষিণ আফ্রিকা: ১৯৯৫ সালে গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন দেশটির পুলিশ সংস্কারের পথ উন্মোচন করে।
এই উদাহরণগুলো দেখায় যে, একটি কার্যকর পুলিশ কমিশন থাকলে পুলিশের জবাবদিহিতা যেমন বাড়ে, তেমনি জনআস্থা ও মানবাধিকারও নিশ্চিত হয়।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান
বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত পুলিশ কমিশন গঠনের ব্যাপারে কোনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। যদিও বিভিন্ন সময় মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা বলেছেন যে, "পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে", কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রে তার বিপরীত চিত্র দেখায়।
তবে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা আংশিকভাবে স্বচ্ছতার প্রতি এক ধরণের প্রতিশ্রুতি দেখায়। কিন্তু সুশীল সমাজ বলছে, তদন্ত কমিটি আর কমিশনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে — কমিশন হলে সেটি স্বতন্ত্র ও স্থায়ী কাঠামো হিসেবে কাজ করতে পারে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক
পুলিশ কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও রয়েছে। কিছু মহল মনে করে, এই ধরনের কমিশন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে দিতে পারে, তাই এ নিয়ে অনিচ্ছা থাকতে পারে।
অন্যদিকে, বিরোধীদল এ দাবিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে — তারা সরকারবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিতে এই দাবি তুলে ধরতে পারে। তাই, কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা তখনই নিশ্চিত হবে, যখন সেটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারবে।
জনগণের প্রত্যাশা
সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা খুবই স্পষ্ট: তারা একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ, ও মানবিক পুলিশ ব্যবস্থা চায়। তারা চায় না যেন পুলিশ হয় কোন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার। তারা চায়, পুলিশ হোক জনগণের বন্ধু — নির্যাতনের নয়, নিরাপত্তার প্রতীক।
এই কমিশন গঠনের দাবি সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন — যেখানে রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা থাকবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে "পুলিশ কমিশন" গঠন শুধু সময়ের দাবি নয়, বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার-ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। এটি শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, পুরো বিচারব্যবস্থাকে আরও গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর করে তুলতে পারে।
তবে এই উদ্যোগ সফল করতে হলে প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনি কাঠামোর সংস্কার এবং সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ। কারণ, আইনশৃঙ্খলা শুধু বাহিনীর বিষয় নয় — এটি রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত চিত্র।
0 Comments