Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

সূর্যমুখী তেল চাষে আগ্রহ বাড়ছে: কৃষির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন

 


ভূমিকা

বাংলাদেশের কৃষি খাত প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যেখানে ধান, পাট, গম ও আখের মতো ঐতিহ্যবাহী ফসলগুলোই ছিল চাষিদের প্রধান অবলম্বন, বর্তমানে সেখানে সূর্যমুখী, তিসি, কinoa বা অলিভের মতো অপ্রচলিত ফসলও জায়গা করে নিচ্ছে। এর মধ্যে সূর্যমুখী তেল চাষ বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। পুষ্টিগুণে ভরপুর ও উচ্চ বাজারদরের কারণে দেশের কৃষকদের মধ্যে সূর্যমুখী চাষে আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।

সূর্যমুখী: একটি সম্ভাবনাময় তেলবীজ ফসল

সূর্যমুখী (Helianthus annuus) একটি বিদেশি ফসল হলেও বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটি এই ফসল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এই উদ্ভিদের বীজ থেকে যে তেল উৎপাদিত হয় তা উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন, হালকা, কোলেস্টেরল মুক্ত এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

সূর্যমুখীর চাষ সাধারণত রবি মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) করা হয়। এর চাষে খরচ কম, সেচের প্রয়োজন কম এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণও তুলনামূলকভাবে কম হয়। ফলে স্বল্প খরচে লাভজনক উৎপাদন সম্ভব হয়।

বাজারে সূর্যমুখী তেলের চাহিদা

বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রতিদিন বাড়ছে। তবে দেশের মোট তেলের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি করে পূরণ করতে হয়, যার একটি বড় অংশই আসে সয়াবিন ও পাম অয়েল দিয়ে। এই নির্ভরতা থেকে মুক্তি পেতে সরকার ও কৃষি বিজ্ঞানীরা বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে সূর্যমুখী তেলকে একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখছেন।

বাজারে সূর্যমুখী তেলের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি, কারণ এটি স্বাস্থ্যসম্মত এবং রুচিসম্মত একটি পণ্য হিসেবে বিবেচিত। গ্রাম ও শহর—উভয় এলাকার সচেতন ক্রেতাদের মধ্যে এর চাহিদা বাড়ছে।

কৃষকদের আগ্রহ ও উদাহরণ

কক্সবাজারের টেকনাফ, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও ও যশোর অঞ্চলে সূর্যমুখী চাষ সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত সীমান্তবর্তী এলাকার কৃষকেরা এই চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কারণ এটি তুলনামূলকভাবে সহজ, লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব।

উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার কৃষক রফিকুল ইসলাম ২০২৩ সালে প্রথম সূর্যমুখী চাষ শুরু করেন। মাত্র ৪০ শতক জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে তিনি ৪৫ হাজার টাকার মতো মুনাফা অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি আরও দুই একর জমিতে এই ফসল চাষ শুরু করেন এবং স্থানীয় আরও অনেক কৃষককেও উৎসাহিত করেন।

উৎপাদন ও প্রযুক্তির ব্যবহার

বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি এনজিওগুলো সূর্যমুখী চাষে নানা রকম প্রশিক্ষণ, বীজ, সার এবং প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করছে। বিএআরআই ৫ ও ৬ নামের দুটি উচ্চফলনশীল জাত এখন কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হচ্ছে।

সূর্যমুখী চাষে জমি তৈরি, সঠিক বীজ নির্বাচন, সময়মতো সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেশিনের সাহায্যে বীজ থেকে তেল নিষ্কাশনও এখন সহজ হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ

তবে সূর্যমুখী চাষে এখনও কিছু বাধা রয়েছে:

মানসম্মত বীজের সংকট: কৃষকরা এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নত জাতের বীজ পাচ্ছেন না।

তেলের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত: গ্রামীণ পর্যায়ে তেল নিষ্কাশনের মেশিন ও সংরক্ষণের প্রযুক্তি সীমিত। তাছাড়া ভোক্তা পর্যায়ে প্রচার কম থাকায় বাজার চাহিদা এখনও সয়াবিন তেলের তুলনায় কম।

মূল্যহীনতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য: অনেক সময় কৃষকরা ন্যায্য দাম পান না, কারণ বাজার ব্যবস্থায় সরাসরি কৃষকের অংশগ্রহণ কম।


সরকার ও সংস্থার ভূমিকা

বাংলাদেশ সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে তেলবীজ ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্যে সূর্যমুখী, সরিষা, তিল ও তিসি—এই সব তেলবীজ ফসলে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করেছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও যেমন ব্র্যাক, এসএএফএ ও কারিতাসও সূর্যমুখী চাষে মাঠ পর্যায়ে সহায়তা দিচ্ছে। কিছু কোম্পানি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সূর্যমুখী বীজ কিনে তেল উৎপাদন করে বাজারজাত করছে, যা কৃষকের আস্থা অর্জনে সাহায্য করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সূর্যমুখী চাষ বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে স্বল্প পানির চাহিদাসম্পন্ন ও পুষ্টিকর ফসল হিসেবে সূর্যমুখী একটি টেকসই সমাধান হতে পারে।

যদি সরকার ও বেসরকারি খাত সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে দেশের ভোজ্যতেল উৎপাদনে সূর্যমুখী একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এটি কেবল আমদানি নির্ভরতা কমাবে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।

উপসংহার

"সূর্যমুখী তেল চাষে আগ্রহ বাড়ছে"—এটি শুধুমাত্র একটি খবর নয়, এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কৃষকরা এখন আগের মতো শুধু ধান কিংবা পাটেই সীমাবদ্ধ নন; তারা নতুন কিছু চেষ্টা করছেন, এবং সফলতাও পাচ্ছেন। সরকারি সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে সূর্যমুখী চাষ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

Post a Comment

0 Comments