ভূমিকা
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে— রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে আক্রমণের কারণে "আগ্রাসনের অপরাধে" একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি শুধু ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের দিক থেকে নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তার সামরিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আইনত জবাবদিহির আওতায় আনা।
ট্রাইব্যুনালের প্রেক্ষাপট
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ও অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে আসে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ঘটনাগুলোকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু এসব অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল, কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) যদিও মানবতা বিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারে, "আগ্রাসনের অপরাধ" বিচার করার পূর্ণ ক্ষমতা তাদের নেই যদি অভিযুক্ত রাষ্ট্র সেই আদালতের সদস্য না হয় — যেমন রাশিয়া।
ট্রাইব্যুনালের লক্ষ্য ও কাঠামো
নতুন এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে:
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে আন্তর্জাতিক আইনে “আগ্রাসনের অপরাধ” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া
দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা, বিশেষত শীর্ষ নেতৃত্ব (যেমন: প্রেসিডেন্ট, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সামরিক জেনারেলরা)
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সমাজের অঙ্গীকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা
এই ট্রাইব্যুনাল হেগে (The Hague) স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন রাশিয়ান নেতার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচারক প্যানেল দ্বারা পরিচালিত হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো এই ট্রাইব্যুনালকে সমর্থন দেবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং জাপান ইতিমধ্যে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই ট্রাইব্যুনালকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার "প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ" বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান জানানো হবে এবং ভবিষ্যতে এমন আগ্রাসনের ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।”
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
রাশিয়া এই উদ্যোগকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, এটি "রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত" এবং "পশ্চিমা শক্তির দ্বিমুখী নীতির প্রতিফলন"। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “আমরা এই ধরনের ট্রাইব্যুনালকে কোনোভাবেই বৈধ বা গ্রহণযোগ্য মনে করি না।”
রাশিয়া এটিকে তাদের সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর আরও প্রভাব পড়তে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
আইনি গুরুত্ব ও দৃষ্টান্ত
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক ন্যায়বিচারের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। অতীতে ১৯৪৫ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়াল বা ১৯৯০-এর দশকে রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল এর দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি, যা ছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। তবে একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে "আগ্রাসনের অভিযোগে" ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বর্তমান বিশ্বে এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ।
চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
এই ট্রাইব্যুনাল বাস্তবায়নে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
আসামিদের হাজির করা — রাশিয়া কোনো আসামিকে স্বেচ্ছায় ট্রাইব্যুনালে পাঠাবে না।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি — জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন না পেলে রাশিয়াসহ চীন এ উদ্যোগকে অবৈধ বলে দাবি করতে পারে।
রাজনৈতিক চাপ ও কূটনৈতিক সংঘাত — এই ট্রাইব্যুনাল ভবিষ্যতে বিশ্ব রাজনীতিতে মেরুকরণ আরও তীব্র করতে পারে।
ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব
যদি এই ট্রাইব্যুনাল সফল হয়, তাহলে এটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আইনকে আরও শক্তিশালী করবে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃঢ় বার্তা দেবে— আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারীরা কোনোভাবেই ছাড় পাবে না, এমনকি যদি তারা পরাশক্তির নেতৃত্বেও থাকে।
এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্য ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। উন্নত দেশগুলোর উচিত হবে এই ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে রেখে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করা।
উপসংহার
রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় পরীক্ষা। এটি দেখাবে, আমরা আসলেই একটি আইনের শাসনের বিশ্বে বাস করি কিনা, না কি ক্ষমতাধরদের জন্য সবকিছুই ছাড়। মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন, এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই ট্রাইব্যুনাল শুধু জরুরি নয়, অপরিহার্য।
0 Comments