Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প

 




ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক (RMG) ও টেক্সটাইল খাত। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে এই শিল্পখাত থেকে। তবে সাম্প্রতিক গ্যাস সংকট পুরো খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গী, ভূলতা ও মাওনার মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপে ভয়াবহ ধস নেমেছে উৎপাদনে। এই সংকটে বিনিয়োগ, রপ্তানি আদেশ, শ্রমিক নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়েছে।


 বর্তমান সংকটের অবস্থা

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাস সরবরাহ অত্যন্ত অনিয়মিত হয়ে পড়ে। অনেক কারখানায় দিনে মাত্র ২-৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারছে না শিল্পকারখানাগুলো।

গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ (BGMEA) জানিয়েছে:

“আমাদের অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে। অনেক কারখানা রপ্তানি আদেশ সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছে না।”


এই গ্যাস সংকটের ফলে যে ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি শিল্পখাত হয়েছে তা ভয়াবহ:

৩০-৪০% উৎপাদন হ্রাস

বিলম্বিত রপ্তানি আদেশ, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে

৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে

শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা, যার ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে

বিদেশি ক্রেতা (Buyer) হারানোর ঝুঁকি, কারণ তারা সময়মতো পণ্য পাচ্ছেন না



কারখানার বাস্তব পরিস্থিতি

নারায়ণগঞ্জের একটি ডাইং কারখানার ব্যবস্থাপক বলেন:

“আমরা ১৬ ঘণ্টার কাজ মাত্র ৫ ঘণ্টায় করতে পারছি। গ্যাস না থাকায় বয়লার চলে না, কাপড় রঙ করতে পারি না, উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।”

এছাড়া অনেক কারখানায় জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদন চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।


 পরিসংখ্যান ও তথ্য

বাংলাদেশে গ্যাসভিত্তিক শিল্পখাত: মোট শিল্প উৎপাদনের ৭০%

শিল্প এলাকায় গ্যাসের চাপ: ১.৫ PSI (সাধারণত ১০ PSI থাকা উচিত)

দ্রুত প্রতিকার না পেলে: বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে


  সংকটের কারণ

এলএনজি আমদানিতে বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধি
স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন হ্রাস
বর্ধিত চাহিদা, কিন্তু সরবরাহ অপর্যাপ্ত
সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং বাজেট ঘাটতির কারণে এলএনজি কিনতে বিলম্ব


 সরকারের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া

সরকার এলএনজি আমদানির চুক্তি করলেও তা যথাসময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন:

“আমরা নতুন করে এলএনজি আমদানি চুক্তি চূড়ান্ত করেছি, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ায় কিছু বিলম্ব হচ্ছে।”

সরকার অস্থায়ীভাবে গ্যাসের রেশনিং চালু করেছে এবং শিল্প খাতকে নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে।


 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের RMG খাতের বড় ক্রেতারা যেমন H&M, Zara এবং Walmart ইতিমধ্যে উৎপাদন বিলম্বের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অনেকেই তাদের অর্ডার অন্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ভারত বা তুরস্কে স্থানান্তর করছে।


 শ্রমিকদের সংকট

যখন উৎপাদন কমে যায়, তখন মজুরি বিলম্বিত হয় এবং ওভারটাইম কমে যায়। এতে শ্রমিকদের আয়ও হ্রাস পায়। কিছু কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে, যা আগামী দিনে একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।


সমাধানের উপায় ও সুপারিশ

অল্পমেয়াদে:

জরুরি ভিত্তিতে এলএনজি আমদানি বাড়ানো

শিল্প অঞ্চলে গ্যাস রেশনিং আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন

জেনারেটরের জন্য সহজ শর্তে জ্বালানি সহায়তা

দীর্ঘমেয়াদে:

বিকল্প জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগ (যেমন: সৌরশক্তি, বায়োমাস)

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো

দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্যাস অপচয় কমানো


  উপসংহার

গ্যাস সংকট শুধু শিল্পখাত নয়, বরং গোটা দেশের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। যেখানে পোশাকশিল্প বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস, সেখানে এর স্থিতিশীলতা ও উৎপাদন নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগে যদি অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে।

বাংলাদেশকে এখনই বিকল্প শক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের জন্য একটি নিরাপদ ও টেকসই শিল্প কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

Post a Comment

0 Comments