খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) সবসময় দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। যেখানে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে। কিন্তু সম্প্রতি একটি হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী এবং অভিভাবকদের মাঝে এক গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে। কুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (EEE) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শান্তনু কর্মকার (২১) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পুকুরে গোসল করতে নেমে মৃত্যু বরণ করেছেন।
দুর্ঘটনার বিবরণ
ঘটনাটি ঘটে ২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। শান্তনু কর্মকার তাঁর কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে ক্যাম্পাসের পুকুরে গোসল করতে যান। খুলনার প্রচণ্ড গরমে একটু স্বস্তির আশায় তারা ওই পুকুরে নামে। শান্তনু সাধারণত সাঁতার জানতেন না বলে জানা গেছে। তবে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতেই তিনি পানিতে নামেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে শান্তনু পানিতে তলিয়ে যেতে থাকেন। বন্ধুরা প্রথমে তা খেলাচ্ছলে নিয়েছিল, তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পারেন যে ঘটনা গুরুতর। সঙ্গে সঙ্গে তারা চিৎকার করে অন্যদের ডেকে তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন। প্রায় ২০-৩০ মিনিটের চেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল শান্তনুকে উদ্ধার করে। পরে তাকে দ্রুত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবার ও সহপাঠীদের প্রতিক্রিয়া
শান্তনু কর্মকারের বাড়ি ছিল যশোর জেলায়। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র ছেলে এবং তার পরিবারের অনেক আশা ছিল তাকে ঘিরে। সন্তানের এমন অকাল মৃত্যুতে শান্তনুর বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মচারীরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। সহপাঠীরা জানান, শান্তনু ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, ভদ্র এবং সদালাপী একজন ছাত্র। তিনি সবসময় বন্ধুদের পাশে থাকতেন, পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন এবং ক্লাসের অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থান
ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক জরুরি বৈঠকে বসে। কুয়েট কর্তৃপক্ষ শান্তনুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে এবং তার পরিবারকে সমবেদনা জানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এক বিবৃতিতে বলেন:
“এই দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একটি গভীর বেদনার বিষয়। আমরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি, তবে এমন ঘটনা প্রতিরোধে আরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং পুকুর এলাকায় প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাশাপাশি, পুকুরের চারপাশে নিরাপত্তা বেড়া, সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড এবং সিসিটিভি স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমেও শান্তনুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা #JusticeForShantanu এবং #KUET_Mourns হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তার স্মরণে বিভিন্ন পোস্ট করে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া উচিত ছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের গোসলের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি কেন।
সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
এই দুর্ঘটনা কুয়েটসহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে। গোসলের মতো বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডও কিভাবে বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে, তার একটি করুণ উদাহরণ এই ঘটনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন পুকুর বা জলাশয় থাকলে তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা উচিত। যদি নিরাপদ না হয়, তবে শিক্ষার্থীদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, ক্যাম্পাসে সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা, প্রথম সাড়া (First Aid) টিম এবং লাইফগার্ড নিয়োগের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেষ কথা
শান্তনু কর্মকারের মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গভীর একটি ট্র্যাজেডি। একজন তরুণ, সম্ভাবনাময় মেধাবীর এভাবে অকালপ্রয়াণ পুরো শিক্ষাঙ্গনকে নাড়া দিয়েছে। তাঁর শূন্যতা পূরণ করার মতো কিছু নেই, তবে এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি আরও সচেতন হয়, তবে হয়তো এমন ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
0 Comments