Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

যে কারণে বন্ধ হলো অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং

 


হঠাৎ করেই বন্ধ হলো অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম: কারণ ও প্রেক্ষাপট

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংক সম্প্রতি দেশের আর্থিক খাতে এক গুরুত্বপূর্ণ সেবার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। ব্যাংকটি ২০১৩ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনগণের জন্য সহজ এবং দ্রুত আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘দুয়ার’ নামে একটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করে। এই সেবা শুরুতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা কমে আসায় অগ্রণী ব্যাংক অনিবার্য হয়ে এ সেবার চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গত শুক্রবার (২০ জুন) ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, যেখানে জানানো হয় ২১ জুন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

এজেন্ট ব্যাংকিং: কি ও কেন?

এজেন্ট ব্যাংকিং হলো একটি আধুনিক ব্যাংকিং সেবা যেখানে ব্যাংকের অনুমোদিত তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা জমা, উত্তোলন, লেনদেন এবং অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং প্রান্তিক এলাকায় ব্যাংক শাখার অভাবে এই সেবা মানুষের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংযুক্ত হওয়ার পথ সুগম করে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই ব্যাংকিং সুবিধা পায়, যা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে।

অগ্রণী ব্যাংক ২০১৩ সালে ‘দুয়ার’ নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সেবা চালু করে। ‘দুয়ার’ গ্রামীণ এলাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক এজেন্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে, যার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ সহজে আর্থিক লেনদেন করতে পেরেছে।

কেন বন্ধ হলো এজেন্ট ব্যাংকিং?

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের মোট ৯৬২টি শাখা রয়েছে। পাশাপাশি ‘দুয়ার’ পরিচালিত ৫৬৭টি এজেন্ট পয়েন্টও কাজ করছিল। গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ‘দুয়ার’ ও অগ্রণী ব্যাংকের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। নবায়নের প্রস্তাব দিলেও, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিছু নতুন শর্ত আরোপ করলে ‘দুয়ার’ সেসব শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে নতুন চুক্তি সই হয়নি এবং এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই শর্তগুলোর মধ্যে থাকতে পারে সার্ভিসের মান নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক শর্ত, রিপোর্টিং পদ্ধতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কঠোরকরণ। যদিও সঠিক শর্তাদি প্রকাশ করা হয়নি, তবে দু’পক্ষের মতবিরোধই কার্যক্রম বন্ধের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

কার্যক্রম বন্ধের প্রভাব ও পরবর্তী পরিকল্পনা

অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হলে গ্রামীণ ও শহরতলির অনেক মানুষকে ব্যাঙ্কিং সুবিধা থেকে আপাতত বঞ্চিত হতে হতে পারে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা কম, সেখানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই এটি বন্ধ হওয়ার প্রভাব কম নয়।

তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ সেবার পরিবর্তে তারা ভবিষ্যতে আরও উন্নত ও আধুনিক ব্যাংকিং সেবা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করবে। তারা শাখা সম্প্রসারণ ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ওপর জোর দেবে। পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন যে, গ্রাহকদের আর্থিক সুবিধা সংক্রান্ত কোনো বিঘ্ন হবে না।

সমালোচনা ও বিশ্লেষণ

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দুয়ার’ এর সঙ্গে চুক্তি না নবায়ন করাটা বেশ একটা চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে যখন দেশের অনেক মানুষ এখনো ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সম্পূর্ণ রূপে যুক্ত হয়নি এবং গ্রামীণ অঞ্চলে এই ধরনের সেবা অপরিহার্য। চুক্তি বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা অন্য কোনো বিকল্পের অপেক্ষায় থাকবেন।

অন্যদিকে, অনেকে মনে করছেন, সময়ের সঙ্গে ‘দুয়ার’ এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কার্যকারিতা কমে আসায় ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংক হয়তো আরো আধুনিক ও নিরাপদ ডিজিটাল সেবায় মনোনিবেশ করতে চায়। ব্যাংকিং খাতে সেবা মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হলে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এজেন্ট ব্যাংকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি দরজা খুলে দিয়েছিল ব্যাংকিং সুবিধার দিকে। ‘দুয়ার’ মত প্রতিষ্ঠানগুলো এ সুযোগের প্রসার ঘটায় এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর ভূমিকা অপরিসীম।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সরকারি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে অর্থ গ্রহণ, সঞ্চয় ও ঋণ কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারে। এতে দেশব্যাপী নগদ অর্থ লেনদেন সহজ হয়েছে, সময় ও খরচ কমেছে।

ভবিষ্যৎ পথ

অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হলেও ব্যাংকটি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। মোবাইল ব্যাংকিং, ই-ওয়ালেট, অনলাইন লেনদেনের মতো সেবা আরও জনপ্রিয় হচ্ছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে আশা করা যাচ্ছে, তারা নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসবে।

তবে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং সুবিধার অব্যাহততা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। ব্যাংকের নতুন পরিকল্পনায় এ অংশটি গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা যায়।


উপসংহার:

অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় দেশের আর্থিক খাতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হলো। যদিও চুক্তি নবায়নের ব্যর্থতা ও শর্ত-নির্ধারণের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের জন্য এর প্রভাব কম হবে না। ভবিষ্যতে ব্যাংকের ডিজিটাল উন্নয়ন ও নতুন উদ্যোগ কীভাবে এ ঘাটতি পূরণ করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Post a Comment

0 Comments