ভূমিকা
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেশের নোটে দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জাতীয় পরিচয় ও ইতিহাসের অংশ হিসেবে তাঁর ছবি সরকারী দলিল, পাঠ্যবই এবং ব্যাংক নোটে থাকা ছিল অনেকটাই অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু ২০২৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন নতুন ১০০০, ৫০০ এবং ২০ টাকার নোট প্রকাশ করল, তখন দেখা যায়—এই নোটগুলোতে বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি নেই। ফলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক, সমালোচনা এবং রাজনৈতিক আলোচনার ঝড়।
নতুন নোটের বিবরণ
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত নতুন ডিজাইনের নোটগুলো আধুনিক নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসহ বাজারে ছাড়া হয়েছে। নতুন নোটে রয়েছে:
উন্নত জলছাপ,
রঙিন নিরাপত্তা সূতা,
ফয়েল স্ট্রিপ,
অ্যান্টি-স্ক্যানিং প্রযুক্তি।
তবে এসব কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের নজর পড়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে—এই প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণ সিরিজের বড় অংকের নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি নেই। এর পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতীক, স্থাপনা বা গণমানুষের চিত্র।
বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলার পেছনের সম্ভাব্য কারণসমূহ
এই সিদ্ধান্তের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো:
রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা রক্ষার চেষ্টা
বর্তমান সরকারের বাইরে একটি তত্ত্বভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়—দেশের নতুন নেতৃত্ব হয়তো একটি নিরপেক্ষ ও অনুগত রাজনীতি তৈরি করতে চাচ্ছে, যেখানে মুদ্রাসহ রাষ্ট্রের মূল কাঠামো বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক না হয়ে অধিকতর সামগ্রিক জাতীয় প্রতীকভিত্তিক হবে।
নতুন নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি
নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালায় কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে ‘জাতির সর্বজনীন ঐক্য’। যেখানে ইতিহাসের চেয়ে বর্তমান উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিকীকরণ ও আধুনিকতার প্রতিফলন
অনেক দেশ তাদের মুদ্রা থেকে রাজনৈতিক প্রতীক বা ব্যক্তিত্বের ছবি বাদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে এমন পরিবর্তন করা হয়ে থাকতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও সামাজিক আলোড়ন
এই পরিবর্তন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদসহ অনেকেই এতে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা এই পরিবর্তনকে সরাসরি 'বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ছবি বাদ দেওয়া মানে তাঁর ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা, যা একটি গভীর রাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে।
বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া
বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে দ্বৈত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কেউ কেউ এটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “রাষ্ট্রকে কোনো একক ব্যক্তিত্ব কেন্দ্রিক না করে সামগ্রিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত করা উচিত।” আবার কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক চাতুরী বলে মনে করছেন।
জনগণের মতামত
অনেক সাধারণ নাগরিক এটিকে অবমাননাকর এবং ইতিহাসবিরোধী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। তাঁরা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “যিনি এই দেশ স্বাধীন করেছেন, তাঁর ছবি নোট থেকে বাদ পড়া মানে জাতির মূল চেতনাকেই অস্বীকার করা।”
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্মদাতা হিসেবে ইতিহাসে অমর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই মহানায়ককে বাদ দিয়ে দেশকে কল্পনা করা অনেকের কাছে অসম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন জাতির পিতা”। ফলে তার ছবি রাষ্ট্রের প্রতীক, যেমন টাকায়, পাসপোর্টে ও জাতীয় দিবসে ব্যবহৃত হওয়া একরকম সাংবিধানিক মর্যাদা বহন করে।
অতীতে যেকোনো সরকার তার ছবি নোটে যুক্ত করে এসেছে, এমনকি অস্থির রাজনৈতিক সময়েও তা বজায় ছিল। এবার এই ধারা পরিবর্তন হওয়া সত্যিই একটি সাংস্কৃতিক মোড়।
প্রযুক্তি ও আধুনিকতার মুখে ইতিহাসচর্চা
বিতর্কের মাঝেও অনেকেই মনে করছেন, ইতিহাসকে কেবল প্রতীকের মাধ্যমে নয়, শিক্ষার মাধ্যমে ধারণ করা উচিত। শুধুমাত্র ছবি সংযুক্ত করেই যদি ইতিহাসের চেতনা বজায় রাখা যায় না, তবে জাতিকে নৈতিক শিক্ষার দিকেও মনোযোগী হতে হবে। একইসাথে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আধুনিক ডিজাইন গ্রহণযোগ্য হলেও ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল প্রতীকগুলো রক্ষার প্রতি সচেতন থাকা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে, এই নতুন সিরিজের নোট ডিজাইন করা হয়েছে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষিতে। এ ছাড়াও বলা হয়েছে, "পুরাতন নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি পূর্বের মতোই থাকবে এবং সেগুলো বৈধ থাকছে। নতুন নোট কেবল একটি পরিপূরক সিরিজ।"
তবে এই বক্তব্যে অনেকে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁরা মনে করছেন, এটি কৌশলীভাবে ইতিহাসকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়ার সূচনা হতে পারে।
উপসংহার
"নতুন টাকায় বঙ্গবন্ধুর ছবি নেই"—এটি কেবল একটি নোটের পরিবর্তন নয়, এটি একটি দেশের সাংস্কৃতিক চেতনা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন। এই পদক্ষেপে সমাজের বিভক্ত মতামত স্পষ্ট হয়েছে। কেউ মনে করছেন এটি যুগোপযোগী, কেউ বলছেন এটি জাতির পিতার মর্যাদাহানিকর। শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
0 Comments