Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী হাউসবোট প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা


টাঙ্গুয়ার হাওর, এটি না শুধুমাত্র বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠো পানির জলাভূমি—১২১০০ হেক্টরেরও বেশি বিস্তৃত—বরং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট এবং রামসার চুক্তির অধীনে সুরক্ষিত একটি “Ecologically Critical Area” হিসেবেও চিহ্নিত । হাওরের এই অনন্যতা তার অগণিত বিল এবং নালায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জলের ভাণ্ডার, বিলুপ্ত‌প্রায় জলজ উদ্ভিদ ও সাঁওতাল বন, বৈচিত্র্যময় মাছ ও ২০০ প্রজাতির শীতকালীন পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও প্রায় ৪০,০০০ জনেরও বেশি মানুষের আজীবিকাভাবের নির্ভরতা এখানে নিযুক্ত

তবে সদ্য‑ই সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ‑টাওয়ার ও তার আশেপাশের সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটকবাহী হাউসবোটের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে  এই নিষেধাজ্ঞা ২০২৫ সালের ২২ জুন রোববার রাতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত) জনাব মোহাম্মদ রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত জরুরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে । রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলজ প্রাণী ও পাখির প্রজননক্ষেত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে ওই নির্দিষ্ট এলাকাগুলো থেকে পর্যটকবাহী হাউসবোট চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে

বিজ্ঞপ্তিটি আরও বলছে, যারা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে । এমন কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার মধ্যে প্রশাসনের একটি মূল লক্ষ্য—বিলুপ্তির পথে থাকা জলজ জীববৈচিত্র্য ও হাওরের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা। বিশেষ করে বর্ষার সময় শুরু হওয়া জলজ প্রাণীর প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত নৌযান চলাচলের ফলে উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব পড়ছে । স্থানীয় পরিবেশ-সংরক্ষক সংগঠন ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, গত দুই দশকে প্রায় ৭০% জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে; যদিও এটি সঠিকভাবে গবেষণায় প্রমাণিত নাও, কিন্তু সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং পর্যটক ও বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা একথা বলছে

প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের জন্য ১২ থেকে ১৪ দফা নির্দেশনা ইতিমধ্যে জারি করা হয়েছে। মূলত, নিম্নলিখিত নির্দেশনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ:

প্রশাসন নির্ধারিত নৌপথ ও “core zone” এর বাইরে থাকা专区র মধ্যে পর্যটকদের যাতায়াত রাখতে হবে

নিরাপদ ভ্রমণের জন্য লাইফজ্যাকেট ব্যবহার, স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জ্য সীমিত রাখার আহ্বান করা হয়েছে

ক্যাম্পফায়ার বা আগুন জ্বালানো, মাছ ধরা, পাখির ডিম সংগ্রহ, রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ (ডিটারজেন্ট/শ্যাম্পু ইত্যাদি), গাছ বা বনজাত সম্পদ সংগ্রহ নিষিদ্ধ

কোনও ধরনের উচ্চ শব্দ, গান‑বাজনা, প্লাস্টিক/অনঅজৈব বর্জ্য হাওরে ফেলা যাবে না

সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না; পার্শ্ববর্তী পর্যটন স্পটে যাবার সময় সকল পুরনো নির্দেশনাও মানতে হবে

পর্যটন নিয়ন্ত্রণের নতুন নিয়মাবলীর সঙ্গে শহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা—যেমন তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা—ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা শিগগিরই হাওরের প্রবেশপথগুলোতে নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড লাগাবেন; পাশাপাশি নাবিক, পর্যটক ও দর্শনার্থীকে সচেতন করতে বিমূর্তভাবে ফ্লায়ার দেওয়া হবে। এ উদ্যোগ বাস্তবে কার্যকর করতে প্রশাসন ইতিমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে।

হাউসবোট পরিচালনাকারীদের একটি নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ধনী পর্যটক বা রাজধানীর বিভিন্ন উৎসব সমৃদ্ধ গ্রুপ এক‑দুইদিনের ঘুমাভরা গ্রীষ্মকালীন ঘোরা‑ফিরার জন্য এখন এই হাওরে ১০০,০০০‑১৫০,০০০ টাকা পর্যটন খরচ করছে । এসব বিলাসবহুল হাউসবোটগুলো গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে হাওরে প্রবেশ করেছে । এর ফলে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংরক্ষকরা ভেবেছেন, “সময়ের সঙ্গে গিয়ে আমাদের জীবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে”

স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনের সভাপতি কাশমির রেজা বলেন:

“টাঙ্গুয়ার হাওর একটি পরিবেশগত‑সংকটাপন্ন এলাকা… গত দুই দশকে এখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে… এগুলো বন্ধ করা না হলে আমরা আরও বড় সংকটের মুখে পড়বো…”

এই মন্তব্য পরিস্কার: স্থানীয়দের মধ্যে দীর্ঘদিনে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি—কিন্তু এবার তা করা হচ্ছে এবং অনেকেই এটিকে “সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয়” উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছেন

প্রতিবাসী অনেকেই মনে করছেন, এটি একটি সূচনামাত্র—আগামীতে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হলে হাওরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যটন-পরিচালন নীতি আরও দৃঢ় হবে। যেখান থেকে হাউসবোট বেড়ে যাচ্ছে, পর্যাবৃত্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে পরিবেশ এবং স্থানীয় জীবন-মান; সেক্ষেত্রে প্রশাসনকেও পরিকল্পিত পর্যটন ব্যবস্থায় মনোযোগ দিতে হবে। বহু জাতীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন IUCN ও Ramsar Secretariat, এই হাওরের গুরুত্ব স্বীকার করে, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও পরিকল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করছে

এই সিদ্ধান্তের ফলে বর্ষা মৌসুমে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সংখ্যা কিছুটা কমতে পারে, তবে এর স্থায়ী প্রভাব অনিশ্চিত। কিছু রিপোর্ট বলছে, অতীতেও পর্যটন হ্রাস পেয়েছে—বিশেষ করে রাজনীতিক অস্থিতিশীলতা বা বন্যার কারণে—তবে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে হাউসবোটের সরবরাহ এখনও প্রচুর ছিল । তবে এখন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নতুন একটি পর্যটন সংস্কৃতির জন্ম নিচ্ছে—সংবেদনশীল, সচেতন, পরিবেশবান্ধব—যা হাওরের দেহ, জ্ঞান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি উভয়েই সমৃদ্ধ করতে পারে।

অবশেষে প্রশাসনের পদক্ষেপটি কেবল একটি সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি আহ্বান—এটি নির্দেশনা এবং সতর্কবার্তা সাহসের প্রতীক যে, বাংলার অন্যতম প্রাকৃতিক অপরূপ হাওর রক্ষা পাবে। হাওরের প্রায় ১০৯টি বিল, বিলুপ্ত উদ্ভিদ, বিপুল জলজ জীব ও বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস-বাতাসে ভরপুর প্রকৃতির পাশে দাঁড়াতে হবে সকলকে—স্থানীয়রা, দর্শনার্থীরা ও প্রশাসন। প্রস্তুত থাকতে হবে পরিকল্পনা ও কাঠামো নিয়ন্ত্রিত পর্যটনে, যেখানে জীববৈচিত্র্য ও মানুষের আজীবন অনুপ্রেরণার সংমিশ্রণ একভাবে সংরক্ষণ করা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর তার প্রকৃতি, পরিযায়ী পাখি, মাছ ও মানুষের ঐতিহ্য নিয়ে থাকলে সেসবই থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ।


সারাংশ:
টাঙ্গুয়ার হাওরে ওয়াচ‑টাওয়ার ও সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটকবাহী হাউসবোট চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে হাওরের জলজ জীববৈচিত্র্য ও প্রজনন মৌসুমের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। প্রশাসনের নির্দেশে ১২–১৪ দফা নিষেধ ও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। স্থানীয় ও পরিবেশবাদীরা এই সিদ্ধান্তকে প্রশংসনীয় মনে করলেও, ভবিষ্যতে বিকল্প পর্যটন ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ প্রয়োজন। এটি কেবল নিরাপত্তার জন্য না, বরং প্রকৃতির সঙ্গে নির্ভরতার একটি নতুন অধ্যায়।

Post a Comment

0 Comments