শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ধর্ষণ মামলা ও গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির বিশ্লেষণ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগে উত্তেজনা ও সামাজিক আলোচনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘটনাটি শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং নৈতিকতার দিক থেকে একটি গভীর সংকটের পরিচায়ক। ধর্ষণ যেমন ব্যক্তি জীবনে বিশাল আঘাত ও মানসিক ক্ষতি আনে, তেমনি এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও সুনামেরও ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত ও সংকল্পবদ্ধ মনোভাব প্রদর্শন করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে যা তার দায়বদ্ধতা ও কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে সকলের নজর কাড়ে।
গত ২০ মে শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আবদুল কাদির স্বাক্ষরিত অফিস আদেশের মাধ্যমে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয় যে, তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মোখলেসুর রহমান। এ ছাড়া কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. বেলাল হোসেন সিকদার। তদন্ত কমিটিকে কম সময়সীমায়, মাত্র তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে, যা পরিস্থিতির গুরত্ব ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার সংকেত বহন করে।
এই পদক্ষেপ স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য একটি কঠিন এবং দায়বদ্ধ কাজ। কারণ, ধর্ষণ মামলা সংবেদনশীল এবং এটি সমাজের বিশেষ একটি অংশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে নিরাপত্তার অভাব বা অবহেলা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। তদন্ত কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করা, সত্য উদঘাটন করা এবং সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা।
এ ঘটনার পটভূমিতে জানা যায়, মেসে নিয়ে অজ্ঞান করে এক নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে সিলেট কোতোয়ালি থানা পুলিশ। অভিযুক্তরা হলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শান্ত তারা আদনান ও স্বাগত দাস পার্থ। এর মধ্যে শান্ত তারা আদনান নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য এবং বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। জুলাই মাসে অভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার মামলায় তার নাম আসামি হিসেবে রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্নবার তিনি সংঘর্ষে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।
এই তথ্যগুলো থেকে দেখা যায়, অভিযুক্তদের নৃশংসতা ও অপরাধ প্রবণতার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি বড় সংকেত হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বাড়ে। অপরাধীদের দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা অন্যদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে।
তদন্ত কমিটির কাজ কেবল দোষীদের শনাক্ত করাই নয়, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোও খতিয়ে দেখা। কীভাবে একজন শিক্ষার্থী এত সহজে অন্য একজন শিক্ষার্থীর ওপর এত গুরুতর অপরাধ ঘটাতে পারে? এর পেছনে প্রশাসনিক দুর্বলতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি, শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার অভাব—এই সব দিক বিবেচনা করা জরুরি। কমিটির প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
অপরদিকে, ঘটনার তীব্রতা ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও আন্দোলনও লক্ষ্য করা গেছে। তারা নিরাপত্তার দাবিতে সঠিক ও দ্রুত বিচার চায়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একটি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও মনোরম শিক্ষাবাতাবরণ নিশ্চিত করতে চায় যা তাদের ব্যক্তিগত ও শিক্ষাগত বিকাশে বাধা সৃষ্টি না করে। প্রশাসনের উচিত হবে ছাত্র-ছাত্রীদের এই নিরাপত্তা চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এই ধর্ষণ মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতার সমস্যা একবার পুনরায় আলোচিত হয়েছে। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নয়, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রশ্ন তুলে ধরে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এই ধরনের ঘটনাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
তদন্ত কমিটির দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রতিবেদন বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনবে এবং প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কারের পথ সুগম করবে। এর মাধ্যমে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী এবং তার পরিবার নিরাশ হবেন না, বরং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তারা মানসিক শান্তি লাভ করতে পারবেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের জন্য এক নিরাপদ ও সুরক্ষিত শিক্ষাবাতাবরণ গড়ে উঠবে।
সার্বিকভাবে, শাবিতে এই ঘটনা ও গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ শুধু একটি ব্যক্তিগত অপরাধের তদন্ত নয়; এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক সংকট মোকাবেলার প্রতিফলন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার ও সমাজের প্রত্যেক স্তরের সম্মিলিত সচেষ্টতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে এমন দুঃখজনক ঘটনা আর কেউ শিকার না হয়। বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে এটি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
0 Comments