বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য ভয়াবহ অস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে, যা মানবসভ্যতাকে বারবার অস্থির করে তুলেছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয় জৈবিক অস্ত্র বা বায়োওয়েপন, যা পরমাণু বোমার চেয়েও বিপজ্জনক এবং মারাত্মক প্রভাবশালী। কারণ, পরমাণু বোমা যেখানে মুহূর্তের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম, জৈবিক অস্ত্র তার প্রভাব ছড়িয়ে দেয় অনেক বিস্তৃত পরিসরে, অনেক ধীরে, নিঃশব্দে এবং অদৃশ্যভাবে। একটি পরমাণু বিস্ফোরণের ধ্বংসযজ্ঞ আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ করতে পারি, কিন্তু জৈবিক অস্ত্রের মাধ্যমে ছড়ানো রোগ জীবাণু মানবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে, যেন একটি অদেখা শত্রুর মতো কাজ করে। রোগটির প্রথম উপসর্গ দেখা দিতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়, এবং ততক্ষণে তা একটি মহামারীর রূপ ধারণ করে, যা একটি নগর, একটি দেশ, এমনকি সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যাকে অচিরেই গ্রাস করে ফেলতে পারে।
ইতিহাসে আমরা অনেকবার মহামারীর ভয়াবহতা দেখেছি। যেমন, ১৪ শতকের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা প্লেগ ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ২০ শতকের স্প্যানিশ ফ্লু এক বছরের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। আজকের দিনে, জৈবিক অস্ত্র একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তৈরি করে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা একটি সাধারণ রোগের চেয়েও অনেক বেশি সংক্রামক, প্রতিরোধহীন এবং প্রাণঘাতী। উদাহরণস্বরূপ, ইবোলা, অ্যানথ্রাক্স, স্মলপক্স বা অন্যান্য মারণাত্মক ভাইরাসকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে পরিবর্তন করে এমনভাবে তৈরি করা যেতে পারে যাতে তা অ্যান্টিবায়োটিক এবং ভ্যাকসিনের মাধ্যমে দমন করা যায় না। এমন একটি জৈবিক অস্ত্র যখন ছড়িয়ে পড়ে, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা এবং অসহায়তা তৈরি করে, যা একটি জাতির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দিতে যথেষ্ট।
পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করলে যে তাৎক্ষণিক এবং দৃশ্যমান ধ্বংসযজ্ঞ হয়, তা একটি সীমিত এলাকায় ঘটে এবং সেই ঘটনার প্রভাব একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু জৈবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে ধ্বংসের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি সংক্রামক রোগ একবার ছড়িয়ে পড়লে তা মুহূর্তে সীমান্ত অতিক্রম করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে আজকের দিনে যেখানে পৃথিবী একটি বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে এবং যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন ইত্যাদি অনেকাংশে আন্তঃসংযোগিত। সুতরাং, একটি সুনির্দিষ্ট এলাকায় ছড়ানোর জন্য তৈরি একটি জৈবিক অস্ত্রও শেষপর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জৈবিক অস্ত্র ব্যবহারকারীদের খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। পরমাণু হামলার পর আমরা সহজেই বুঝতে পারি হামলাটি কোথা থেকে এসেছে, কিন্তু একটি জৈবিক হামলার ক্ষেত্রে তা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না। একটি জীবাণু নিঃশব্দে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, অনেক সময় এর উৎসও অজানা থাকে, ফলে এর পেছনে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা অনায়াসে আত্মগোপন করতে পারে। এই অজ্ঞাত এবং ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া হুমকিই জৈবিক অস্ত্রকে এত ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
এমন অস্ত্র কেবল সরাসরি মানুষ হত্যা করে না; এর একটি পরোক্ষ এবং ভয়াবহ প্রভাব থাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে। একবার মহামারী ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালগুলো রোগীতে পূর্ণ হয়ে পড়ে, চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভাঙন দেখা দেয়, অর্থনীতির চাকাও থেমে যেতে শুরু করে এবং খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য হাহাকার দেখা দেয়। জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক, ভীতি এবং অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ে, যা একটি সমাজকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম। এমনকি সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমে যেতে থাকে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।
পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি থাকলেও, জৈবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ অনেকটাই জটিল এবং অনিশ্চিত। এর জন্য বিশ্বের সমস্ত দেশের মধ্যে শক্তিশালী সহযোগিতা প্রয়োজন। কেননা, একটি মাইক্রোঅর্গানিজম তৈরি করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি ছোট ল্যাবরেটরিই যথেষ্ট, এবং এর বিরুদ্ধে আগাম সনাক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাটা অনেক কঠিন। বিশ্বের অনেক দেশই জৈবিক অস্ত্র তৈরি এবং গবেষণায় নিযুক্ত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যা মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য এক বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরমাণু অস্ত্রের বিপরীতে জৈবিক অস্ত্রের আরেকটি বড় সুবিধা হলো এর ব্যবহারের খরচ অনেক কম এবং তা খুবই সহজে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। একটি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস, যা একটি পরীক্ষাগারে তৈরি করা সম্ভব, তা যদি সঠিক সময়ে এবং সঠিক পরিবেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তা একটি ভয়াবহ মহামারী সৃষ্টি করতে সক্ষম। এটি যেমন একটি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তেমনি সারা বিশ্বের স্বাভাবিক কার্যক্রমকেও স্থবির করে দিতে পারে।
সুতরাং, জৈবিক অস্ত্র মানবসভ্যতার জন্য একটি অদেখা, ধীরে কার্যকর, কিন্তু পরমাণুর চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক হুমকি। এর প্রতিরোধে সরকারগুলোকে এখনই সচেতন হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলকে একসঙ্গে কাজ করে এর গবেষণা, উৎপাদন এবং সম্ভাব্য ব্যবহারের ওপর কঠোর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। এর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে হবে।
পরমাণু বোমা হয়তো এক মুহূর্তে একটি শহরকে ধ্বংস করে দিতে পারে, কিন্তু একটি অনিয়ন্ত্রিত জৈবিক অস্ত্র ধীরে ধীরে, অদৃশ্যভাবে এবং অনেক বেশি গভীরে প্রবেশ করে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে। এটি একটি "নীরব হত্যাকারী", যা মানবসভ্যতার জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে এবং সেজন্য এর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি এবং সচেতনতা এখনই জরুরি।
0 Comments