Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

বৈসাবি: পাহাড়ি আদিবাসীদের নববর্ষ উৎসব

 


বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্যতম বৈচিত্র্যময় ও সাংস্কৃতিক উৎসব হলো বৈসাবি। এটি মূলত একটি সম্মিলিত উৎসব, যা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি, খিয়াং, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই, মণিপুরি, সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপন হিসেবে পরিচিত। ‘বৈসাবি’ শব্দটি তিনটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপন নাম থেকে এসেছে—বৈ (বৈসু, ত্রিপুরা), সা (সাংগ্রাই, মারমা), ও বি (বিঝু, চাকমা)। বৈসাবি শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়; এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতীক।


উৎসবের সময় ও পরিধি

বৈসাবি উৎসব সাধারণত চৈত্র মাসের শেষ কয়েকদিনপহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষে উদযাপিত হয়। এটি সাধারণত ১২ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুযায়ী আলাদা তারিখে পালন করে থাকলেও মূলত চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষকেন্দ্রিক সময়েই উৎসবটি সম্পন্ন হয়।


উৎসবের মূল অংশ ও ধারা

১. বিঝু (চাকমা সম্প্রদায়)

চাকমাদের নববর্ষ উৎসব ‘বিঝু’ তিন দিনব্যাপী পালন করা হয়:

  • প্রথম দিন: ফুলবিঝু – এদিন ভোরে ছোট-বড় সবাই নদী বা ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে গৃহস্থালী পরিষ্কার করে, ফুল তোলে, বাড়ির উঠান পরিষ্কার করে এবং ফুল দিয়ে বাড়ি সাজায়। তরুণীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ফুল হাতে নিয়ে প্রভাতে ফুলবিঝু উদযাপন করে।

  • দ্বিতীয় দিন: মূলবিঝু – এই দিনে চলে খাদ্য উৎসব। ১০-১২ রকমের সবজি দিয়ে রান্না করা ‘পাচন’ বা ‘বৈচিত্র্যময় তরকারি’ খাওয়া হয়। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।

  • তৃতীয় দিন: গোজ্যাপবিঝু – এই দিনে লোকজন মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করে এবং পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পানিতে ফুল, ধূপ ও মোমবাতি ভাসায়। বয়স্কদের শ্রদ্ধা জানানো ও তরুণদের আশীর্বাদ প্রদানের মাধ্যমে দিনটি শেষ হয়।


২. সাংগ্রাই (মারমা সম্প্রদায়)

মারমা জনগোষ্ঠী তাদের নববর্ষকে ‘সাংগ্রাই’ নামে অভিহিত করে। এটি মূলত থাই-বর্মি ঐতিহ্যবাহী থিং ইয়ান উৎসবের মতো, যা মিয়ানমার, থাইল্যান্ড বা লাওসের জনগণও পালন করে থাকে।

  • সাংগ্রাই-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো জল ছিটিয়ে শুদ্ধতা অর্জনের প্রতীকী রীতি। তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানান ও পুরনো বছরের সব দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে ফেলতে চায়।

  • মারমা তরুণীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নাচ-গান পরিবেশন করে, এবং প্রার্থনা ও পুণ্যদান করা হয়।

  • পাহাড়ি প্যাগোডা বা বৌদ্ধ বিহারে প্রার্থনা ও বুদ্ধ মূর্তিতে জল ঢালার রীতি পালিত হয়।


৩. বৈসু (ত্রিপুরা সম্প্রদায়)

ত্রিপুরাদের নববর্ষ উৎসব ‘বৈসু’। এটি এক বা দুই দিনব্যাপী পালন করা হয়। বৈসু-তে উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো:

  • ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরা নৃত্য – ত্রিপুরা তরুণীরা দলবদ্ধভাবে ঢোলের তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করে।

  • পানীয় ও ভোজন – পরিবারের সদস্যরা মিলে বিশেষ রান্না করা হয়, যেমন বাঁশে রান্না করা মাংস বা সবজি।

  • বয়স্কদের আশীর্বাদ গ্রহণ – সমাজের প্রবীণদের শ্রদ্ধা জানানো ও তাদের কাছ থেকে নতুন বছরের আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয়।


বৈসাবির সাংস্কৃতিক উপাদান

বৈসাবির সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে সাজায় এবং একে অপরকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। এই উৎসবের আরও কিছু সাংস্কৃতিক দিক নিচে তুলে ধরা হলো:

  • ঐতিহ্যবাহী পোশাক: নারীরা পরিধান করে পিনোন, রিনাই, থান বা মারমা থামিন। পুরুষরা পরে ধুতি, জামা বা গামছা। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর পোশাক আলাদা ও রঙিন।

  • সাংস্কৃতিক পরিবেশনা: গান, নাটক, পুঁথি পাঠ, লোকনৃত্য, ঢোল ও বাঁশির সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।

  • খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতা: তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দড়ি টানাটানি, হাঁড়িভাঙা, লাঠিখেলা, ঐতিহ্যবাহী তীরন্দাজি, ও রান্না প্রতিযোগিতা।

  • মেলা ও হস্তশিল্প বিক্রি: স্থানীয়ভাবে তৈরি নানা রকম হস্তশিল্প, পোশাক ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে বৈসাবি মেলা বসে।


ধর্মীয় দিক ও পুণ্যকর্ম

বৈসাবি উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ধর্মীয়তা ও মানবসেবার প্রতি আগ্রহ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করে, বুদ্ধ মূর্তিতে জল ঢালে এবং গরিবদের মাঝে দান করে। এসব প্রথা নতুন বছরের শুদ্ধতা, শান্তি ও মঙ্গল কামনার প্রতীক।


বৈসাবির সামাজিক গুরুত্ব

  • সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি: বৈসাবি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একটি অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ করে। এতে জাতিগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে।

  • আত্মপরিচয়ের প্রকাশ: এই উৎসব পাহাড়ি জনগণের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় রক্ষার অন্যতম বাহন।

  • সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যম: এই উৎসবে গ্রামের মানুষ, শহরের নাগরিক ও তরুণ প্রজন্ম সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। এতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।



রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সরকারি ভূমিকা

বর্তমানে বৈসাবি উৎসবটি সরকারিভাবে স্বীকৃত একটি জাতীয় সংস্কৃতিক উৎসব। সরকার এ উপলক্ষে পার্বত্য জেলাগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। জেলা প্রশাসন, সাংস্কৃতিক সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এমনকি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও বৈসাবি উৎসব উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে।


চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

যদিও বৈসাবি এখন বৃহৎ উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে:

  • পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না থাকা

  • সামাজিক বিভাজন ও সংস্কৃতির ভুল ব্যাখ্যা

  • বাণিজ্যিকরণ ও সাংস্কৃতিক মূলবোধের ক্ষতি

তাই, ভবিষ্যতে বৈসাবিকে টেকসই ও সুসংগঠিতভাবে রক্ষা করতে হলে পাহাড়ি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সংস্কৃতি-ভিত্তিক শিক্ষা চালু করা, এবং সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন


উপসংহার

বৈসাবি শুধু একটি উৎসব নয়, এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, সৌহার্দ্য ও শান্তির প্রতীক। বাংলাদেশের বহুসংস্কৃতির গর্ব এই বৈসাবি আমাদের শেখায়—ভিন্নতার মাঝেও ঐক্য সম্ভব। বৈসাবির মাধ্যমে পাহাড় ও সমতলের মানুষ একসঙ্গে উৎসব উদযাপন করে, যা দেশের সার্বিক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

Post a Comment

0 Comments