বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো কৃষি। জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এই খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই পুরুষশাসিত হিসেবে বিবেচিত হলেও, সাম্প্রতিক দশকে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। নারীরা এখন শুধু কৃষি শ্রমিক নন, বরং উদ্যোক্তা, খামার মালিক ও কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
নারীদের কৃষিতে অংশগ্রহণ: প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে নারীরা সবসময়ই কৃষিকাজে জড়িত থেকেছেন। তারা ধান রোপণ, গবাদিপশু পালন, শাকসবজি উৎপাদন, মাছ চাষ, এবং এমনকি বীজ সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে পূর্বে এই কাজগুলো গৃহস্থালির অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং অর্থনৈতিক মূল্যায়নে এর প্রতিফলন থাকত না।
বর্তমানে সরকার, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নানা উদ্যোগের ফলে নারীদের কৃষি খাতে আনুষ্ঠানিক ও স্বীকৃত অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা এখন কৃষিকাজের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-ভিত্তিক ব্যবসা এবং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উদ্যোগেও যুক্ত হচ্ছেন।
পরিসংখ্যান ও গবেষণা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট কৃষি শ্রমিকের প্রায় ৪৮% এখন নারী। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গ্রামীণ এলাকায় অনেক পরিবারে পুরুষেরা শহরে কাজের খোঁজে চলে যাওয়ার কারণে নারীরাই পরিবার ও কৃষির দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছেন।
আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামীণ নারীরা গড়ে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা কৃষিকাজে ব্যয় করেন। এতে তাদের শ্রমমূল্য অবদান বাড়লেও এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হন।
নারীদের কৃষিতে অগ্রণী ভূমিকা
ফসল উৎপাদনে নেতৃত্ব
নারীরা এখন শুধুমাত্র ফসল রোপণ বা পরিচর্যায় সীমাবদ্ধ নেই, তারা কৃষি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাতেও অংশ নিচ্ছেন। অনেক নারী কৃষক এখন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যেমন—সেচ যন্ত্র, আধুনিক বীজ, জৈব সার ইত্যাদি। তারা নিজেরাই চাষের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, জমির মালিকানা গ্রহণ করছেন এবং বাজারে ফসল বিক্রি করছেন।
কৃষি-উদ্যোক্তা হিসেবে নারী
নারীরা কৃষি-ভিত্তিক ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ শুরু করছেন—যেমন হাঁস-মুরগি খামার, গবাদিপশু পালন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফুল চাষ, চারা উৎপাদন ইত্যাদি। অনেকেই এনজিও বা সরকারি ঋণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
পরিবেশবান্ধব কৃষিতে অবদান
নারীরা প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চার দিকে বেশি ঝুঁকছেন। তারা জৈব সার ব্যবহার, ফসলের বৈচিত্র্য বজায় রাখা, এবং পানির সাশ্রয়ী ব্যবহারে মনোযোগী হচ্ছেন। এই প্রবণতা টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি
বর্তমানে অনেক নারী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়াশোনা করছেন এবং কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। এদের মধ্যে অনেকে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নারীবান্ধব কৃষি যন্ত্র ও পদ্ধতির উন্নয়নে কাজ করছেন।
সফল নারীর গল্প
ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার সুমি আক্তার তিন বিঘা জমিতে নিজের হাতে শাকসবজি চাষ করে একটি মডেল কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি জৈব পদ্ধতিতে চাষ করে প্রতিবছর প্রায় তিন লক্ষ টাকা আয় করেন। এখন তিনি আশপাশের নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং একটি নারীবান্ধব কৃষি সমবায় গড়ে তুলেছেন।
এ ধরনের বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে নারী কৃষকরা শুধু নিজেদের জীবিকা নয়, বরং একটি কমিউনিটির পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা
尽管 নারীদের অগ্রগতির ধারা সুস্পষ্ট, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে:
সম্পত্তির মালিকানা: অনেক নারী এখনও জমির মালিকানা পান না, যা ঋণ নেওয়া বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।
প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি: নারীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার শেখার সুযোগ এখনো সীমিত।
বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা: নারী কৃষকরা অনেক সময় বাজারে গিয়ে ফসল বিক্রি করতে পারেন না, পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: অনেক গ্রামাঞ্চলে এখনো নারীদের কৃষিনেতৃত্ব বা ব্যবসা পরিচালনাকে ভালোভাবে দেখা হয় না।
উন্নয়নের জন্য করণীয়
নারীদের নামে জমি রেজিস্ট্রেশন সহজ করা।
নারীবান্ধব কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা।
কৃষি ঋণ গ্রহণে বিশেষ সুবিধা ও জামানতবিহীন ঋণ ব্যবস্থা।
মার্কেটিং চেইনে নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
নারীদের জন্য নিরাপদ কৃষি বাজার ও সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন।
উপসংহার
নারীরা আজ আর কৃষির পেছনের ছায়ামূর্তি নন, বরং সামনে এগিয়ে এসে কৃষি অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। যদি তাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়, সুযোগ-সুবিধা ও প্রযুক্তির সহায়তা প্রদান করা হয়, তাহলে নারীরা শুধু কৃষিকে নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নারীর হাত ধরেই আরও আলোকিত হতে পারে।
0 Comments