ভূমিকা
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাত ও অবরোধের ফলে তৈরি হওয়া ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে সম্প্রতি আরও একটি করুণ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Food Programme - WFP) জানিয়েছে যে, গাজার একটি প্রধান খাদ্য গুদাম ক্ষুধার্ত জনতার দ্বারা লুটপাটের শিকার হয়েছে। শত শত মানুষ মিলে গুদামটি ঘিরে ধরে খাদ্যসামগ্রী লুট করেছে, যা গাজার বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রকাশ করে।
এই ঘটনা শুধু একটি লুটপাট নয়, বরং এটি একটি জাতির বেঁচে থাকার আকুতি, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে উপেক্ষিত এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
ঘটনার বিবরণ
২০২৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে গাজার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত জাতিসংঘ পরিচালিত একটি খাদ্য গুদামে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটে। WFP-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, গুদামটিতে হাজার হাজার টন খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষিত ছিল যা যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করার উদ্দেশ্যে সেখানে রাখা হয়েছিল।
তবে গাজায় চলমান ইসরায়েলি অভিযানের ফলে অবরুদ্ধ এলাকাগুলিতে খাদ্য, পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ বা সীমিত হওয়ায় সাধারণ মানুষ দিন দিন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতির কারণে জনগণ বাধ্য হয়ে গুদামটি ঘিরে ধরে এবং তা ভেঙে খাদ্য লুট করে।
মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপট
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ চরম দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকটে পড়েছে। ইসরায়েলি সেনা অভিযান ও বিমান হামলার ফলে অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, বাজার, রাস্তা ও হাসপাতালগুলোও কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় প্রতিদিন ৯০% মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজায় বর্তমানে পর্যাপ্ত খাবার পাঠানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে, কারণ ইসরায়েল সীমান্ত দিয়ে সাহায্য সামগ্রী প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
লুটপাট কেন হলো?
এই লুটপাট কোনো অপরাধমূলক সংগঠনের কাজ নয়, বরং এটি ছিল ক্ষুধার্ত মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যখন কারও পেটে খাবার থাকে না, সন্তান ক্ষুধায় কাঁদছে, তখন সে আইনের পরোয়া করে না। এটাই ঘটেছে গাজায়।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক পরিবার কয়েকদিন ধরে একবেলা খাবার পাচ্ছিল না। শিশু ও বৃদ্ধরা অনাহারে মারা যাচ্ছিল। ফলে হাজার হাজার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুদাম লুটে বাধ্য হয়।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির উদ্বেগ
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘটতে পারে যদি দ্রুত মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া হয়। তারা আরও জানায়, এই লুটপাট তাদের জন্য এক ধরনের সতর্ক সংকেত। যদি মানুষকে নিয়মিতভাবে খাদ্য সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে এভাবে গুদামগুলো আক্রান্ত হতে থাকবে, এবং সহায়তা কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব
গাজার এই লুটপাটের ঘটনা পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি অ্যালার্মিং সিগন্যাল। এই সংকট আর কোনো নিরপেক্ষ মানবিক ইস্যু নয়, এটি এখন একটি নৈতিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের বিধ্বস্ত এই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা প্রবেশ করাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর দেশগুলোর উদ্যোগ আরও জোরালো হওয়া দরকার।
তারা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে এবং তা কেবল একটি জনপদের নয়, গোটা বিশ্বের নৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে উঠবে।
ভবিষ্যৎ কী?
এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো:
মানবিক করিডোর খোলা রাখা – যেন খাদ্য, ওষুধ, পানি সহজেই গাজায় প্রবেশ করতে পারে।
স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা – যাতে সাময়িক হলেও বেসামরিক মানুষদের রক্ষা করা যায়।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও এনজিও-দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা – যাতে তারা সহায়তা কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালাতে পারে।
উপসংহার
গাজার খাদ্য গুদাম লুট কোনো চমকপ্রদ বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সমাজের চরম দুরবস্থার প্রতিফলন। এটি বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ বাঁচার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তাই করে। যদি আমরা সত্যিই মানবতা ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি, তাহলে গাজা যেন দ্বিতীয় ইয়েমেন বা সিরিয়া না হয়, সে জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্ব যেন আজ না হয় কাল বিলাপ করে না থাকে।
0 Comments