Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর ইসরায়েলে ৯৪০টি অস্ত্রের চালান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র: মানবিক ও কূটনৈতিক উদ্বেগ বাড়ছে

 


ভূমিকা

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে শুরু হওয়া নতুন সংঘাতের পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এই সংঘাতের ধারাবাহিকতায় ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। আর এই অভিযানের প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করে।

সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম এবং স্বয়ং মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের (Pentagon) বরাত দিয়ে জানা গেছে, গাজায় অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে প্রায় ৯৪০টি অস্ত্রের চালান পাঠিয়েছে। এই সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং মানবাধিকার পরিস্থিতিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।


অস্ত্রের ধরন ও পরিমাণ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে পাঠানো এই অস্ত্রের চালানের মধ্যে রয়েছে:

“স্মার্ট বোমা” (Precision-guided bombs) – JDAM (Joint Direct Attack Munition)

১০০০ পাউন্ড এবং ২০০০ পাউন্ড ওজনের বোমা

আর্টিলারি শেল

“স্মোক বম্ব” ও টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড

রকেট লঞ্চার, হেলিকপ্টার এবং ড্রোন সাপোর্ট সিস্টেম

নাইট ভিশন, বুলেটপ্রুফ গিয়ার ও অস্ত্র নির্মাণ উপকরণ

এই চালানগুলোর একটি বড় অংশ গোপনে পরিচালিত হয়েছে এবং এর অনেক তথ্য প্রকাশ্যে আনা হয়নি। সংবাদ সংস্থা The Washington PostCNN জানিয়েছে, কংগ্রেসীয় পর্যালোচনা ছাড়াই অনেক অস্ত্র পাঠানো হয়েছে, যার ফলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।


কেন এই অস্ত্র সহায়তা?

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বছরে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়। কিন্তু গাজায় চলমান আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে এই সহায়তা বিতর্কের মুখে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে:

“ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে এবং আমরা আমাদের মিত্র দেশকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” – (পেন্টাগন মুখপাত্র)

তবে সমালোচকদের দাবি, এই অস্ত্রগুলো “আত্মরক্ষার” তুলনায় “আক্রমণের” হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার ফলাফল ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।


গাজায় এই অস্ত্র ব্যবহারের প্রভাব

মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার নাগরিক এলাকা ও শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের আক্রমণে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও নারী নিহত হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে:

গাজায় নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৩৫,০০০ ছাড়িয়েছে

শিশু মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বেড়েছে

হাসপাতাল, স্কুল ও জাতিসংঘ পরিচালিত ভবনও হামলার শিকার

Amnesty International এবং Human Rights Watch অভিযোগ করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ভারী অস্ত্রই এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে মূল সহায়তাকারী।


কংগ্রেসের বিতর্ক

মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য এই অস্ত্র চালান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ডেমোক্রেট দলের বামপন্থী সদস্যরা বলছেন, এই সহায়তা মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী।

বর্ণি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্টেজ, রাশিদা তালিব সহ বেশ কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য অস্ত্র চালান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

তাদের বক্তব্য:

“এই অস্ত্র গাজায় শিশু হত্যার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা কোনো মিত্রতার পরিচয় নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমর্থন।” – রাশিদা তালিব


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের কারণে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন:

“গাজায় যে ধ্বংস চলছে তা কোনোভাবে আত্মরক্ষা বলা যায় না।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অস্ত্র সরবরাহ শুধু গাজায় বিপর্যয় নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের বীজ বপন করছে।


যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উদ্দেশ্য?

অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এই অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে কিছু কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জন করতে চাইছে:


মধ্যপ্রাচ্যে নিজের উপস্থিতি ও প্রভাব বজায় রাখা

ইরান, হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে বার্তা দেওয়া

নিজেদের অস্ত্র শিল্পকে সক্রিয় রাখা

তবে এই কৌশল মানবিক মূল্য কতটা নিচ্ছে, তা নিয়েই বিতর্ক।


নৈতিক প্রশ্ন

এই পুরো পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও তার পররাষ্ট্রনীতিকে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্ন হলো:

যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই “মানবাধিকার” এবং “গণতন্ত্রের” পক্ষে?

নাকি তাদের পক্ষে শুধু নিজেদের মিত্ররা, যাদের সঙ্গে কৌশলগত চুক্তি রয়েছে?

এই প্রশ্গুলো আজ শুধু আমেরিকার অভ্যন্তরেই নয়, বরং পুরো বিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে।


উপসংহার

গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪০টি অস্ত্র চালান শুধু একটি সংখ্যার হিসাব নয়, এটি একটি গভীর নৈতিক সংকট, একটি মানবিক বিপর্যয়ের সহায়ক শক্তি। বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বের সব মানুষের, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব, মানবিক সংগঠন ও সচেতন নাগরিকদের উচিত এই ইস্যুতে সোচ্চার হওয়া।

অস্ত্র নয়, দরকার শান্তির। গাজা যেন আরেকবার যুদ্ধের খেলা না হয়, বরং হোক ন্যায়বিচার ও মানবতার প্রতীক – সেই প্রত্যাশাই রইলো।

Post a Comment

0 Comments