ভূমিকা
বাংলাদেশের নাটক ও সিনেমা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। অভিনয়ে যিনি ছিলেন অনন্য, জীবনবোধে ছিলেন ব্যতিক্রম, আর দর্শকদের মনে আজও গেঁথে আছেন অমলিন স্মৃতির মতো। ১৯৫২ সালের ২৯ মে জন্ম নেওয়া এই অভিনেতা আজ বেঁচে থাকলে ৭৪ বছরে পা রাখতেন। কিন্তু ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে তিনি চিরতরে চলে যান আমাদের মাঝ থেকে।
তাঁর জন্মদিনে আজ তাকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও গভীর বেদনার সাথে।
শুরুটা কোথা থেকে
হুমায়ুন ফরীদি জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার নারিন্দায়। তাঁর বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বাবার চাকরির কারণে ছোটবেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতে হয় তাকে। মাধ্যমিক শেষ করেন চাঁদপুর হাইস্কুল থেকে, উচ্চ মাধ্যমিক ঢাকার নটরডেম কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পড়াশোনায় বিরতি পড়ে।
পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে, এখানেই নাট্যজগতে তাঁর প্রবেশ।
অভিনয়ে পথচলা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নাট্যকার সেলিম আল দীনের সাহচর্যে নাট্যদলে যুক্ত হন। এরপর তাঁর নাট্যজীবনের শুরু হয় মঞ্চনাটক দিয়ে।
বিশেষ করে "আত্মস্থ ও হরিণ", "মুনতাসির ফ্যান ক্লাব", "শকুন্তলা"– এসব নাটকে তাঁর অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়। তিনি ছিলেন নাট্যচক্র, আরণ্যক নাট্যদল ও পরবর্তীতে নিজে গড়া নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়-এর সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত।
মঞ্চ থেকে টিভি পর্দায় এবং পরে সিনেমা জগতে তার জয়যাত্রা শুরু হয়।
টেলিভিশন নাটকে অবিস্মরণীয় অবদান
১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকে যখন রেনেসাঁ চলছে, তখন ফরীদি ছিলেন অগ্রগামী শিল্পীদের একজন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে:
ভাঙনের শব্দ শোনা যায়
সংশপ্তক (তাঁর "কানকাটা রমজান" চরিত্রটি অমর হয়ে আছে)
কোথাও কেউ নেই
ম্যাডাম ফুলি
নাগরিক
চাঁদনী রাত
বেহুলা
তিনি প্রতিটি চরিত্রে অনন্য অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।
সিনেমায় দাপুটে পদচারণা
হুমায়ুন ফরীদি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন নব্বইয়ের দশকে এবং খুব অল্প সময়েই নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র:
একাত্তরের যীশু
ভণ্ড
বিশ্বপ্রেমিক
হুলয়া
ব্যাচেলর
মাতৃত্ব
জয়যাত্রা
শ্যামল ছায়া
২০০৪ সালে “মাতৃত্ব” চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
অভিনয়ের বৈচিত্র্য
ফরীদির অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল তার এক্সপ্রেশন, কণ্ঠস্বর, সংলাপ বলার ভঙ্গি ও শরীরী ভাষা। একদিকে যেমন খল চরিত্রে তিনি ছিলেন ভয়ংকর, অন্যদিকে হাস্যরসাত্মক ও মানবিক চরিত্রেও সমান সাবলীল।
তিনি ছিলেন সেই বিরল অভিনেতাদের একজন, যিনি চোখ দিয়েও সংলাপ বলতে পারতেন। তাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল পর্দায় এক ধরনের অতল গভীরতা।
ব্যক্তিজীবন ও দর্শন
হুমায়ুন ফরীদি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অন্তর্মুখী, কিন্তু চিন্তাশীল ও দার্শনিক মানসিকতার মানুষ। জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও শিল্প নিয়ে তার ভাবনা ছিল গভীর।
তিনি অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তবে পরে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। একমাত্র কন্যাসন্তান ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রেরণা।
প্রস্থানের বেদনা
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান হুমায়ুন ফরীদি। তার মৃত্যু শুধু একজন শিল্পীর মৃত্যু নয়—এটা ছিল এক যুগের অবসান।
বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা আজও পূরণ হয়নি।
প্রতিভার স্বীকৃতি ও পুরস্কার
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০০৪)
মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার
বাংলাদেশ টেলিভিশন পুরস্কার
স্মরণীয় অগণিত দর্শক ভালোবাসা
মৃত্যুর পরে ২০১৮ সালে তিনি একুশে পদক-এও ভূষিত হন, যা ছিল তাঁর শিল্পযাত্রার মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি।
হুমায়ুন ফরীদি বেঁচে আছেন, থাকবেন
ফরীদির অভিনীত নাটক বা সিনেমা যতবারই দেখুন না কেন, মনে হবে তিনি যেন এখনো অভিনয় করে চলেছেন। দর্শকদের হৃদয়ে তাঁর অবস্থান এতটাই গভীর যে, সময় কিংবা প্রজন্ম বদলালেও তিনি চিরন্তন শিল্পীর আসনে আসীন থাকবেন।
নতুন প্রজন্মের অনেক অভিনয়শিল্পী তার অভিনয় শৈলী থেকে অনুপ্রাণিত হন। চলচ্চিত্র ও থিয়েটারের পাঠ্যক্রমে তাঁর চরিত্র ও অভিনয়কে এখন গবেষণার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
উপসংহার
হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন এক নাট্য-দার্শনিক, এক অভিনয়-জাদুকর। তাঁর প্রতিটি চরিত্র ছিল নিখুঁত, প্রতিটি সংলাপ ছিল সময়ের ওপারে ছুঁয়ে যাওয়া এক ধ্বনি। আজ তাঁর জন্মদিনে আমরা শুধু স্মরণ করি না, বরং আমরা তাঁর শূন্যতাকে নতুন করে অনুভব করি।
0 Comments