ভূমিকা
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নায়ক সজল এবং নায়িকা শবনম বুবলী একসঙ্গে কাজ করছেন একটি নতুন সিনেমায়। পাহাড়, ঝরনা ও সবুজ প্রকৃতির মোহে শুটিংয়ের জন্য তারা বেছে নিয়েছিলেন বান্দরবানের দুর্গম একটি লোকেশন। কিন্তু সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হঠাৎই রূপ নেয় ভয়ংকর এক বিপর্যয়ে—বন্য হাতির আক্রমণে শুটিং ইউনিটে সৃষ্টি হয় হুলুস্থুল অবস্থা।
প্রাণে বেঁচে গেলেও সজল-বুবলী এবং ইউনিটের অন্যান্য সদস্যরা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়েছেন। এই ঘটনা দেশের বিনোদন অঙ্গনে যেমন আলোড়ন তুলেছে, তেমনি উঠেছে লোকেশন নিরাপত্তা ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন।
ঘটনার বিস্তারিত
ঘটনাটি ঘটে ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে, বান্দরবানের থানচি উপজেলার গভীর জঙ্গলে। সিনেমাটির একটি রোমান্টিক গানের দৃশ্যের শুটিং চলছিল যেখানে সজল ও বুবলী প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইউনিট যখন গানের দৃশ্য ধারণে ব্যস্ত, হঠাৎই কাছের বনের দিক থেকে একটি বন্য হাতির দল (সংখ্যা ৩-৪টি) বেরিয়ে এসে শুটিং ইউনিটের দিকে ছুটে আসে। সবাই প্রাণভয়ে দৌঁড়ে আশ্রয় নেয় কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায়। বুবলী লুকিয়ে পড়েন এক পাথরের আড়ালে, সজল দৌঁড়ে পাশের কুঁড়েঘরের নিচে আশ্রয় নেন।
কীভাবে রক্ষা পেলেন তারা?
যদিও কিছু ক্যামেরা ও লাইট ভাঙচুর হয়, তবে সবচেয়ে বড় স্বস্তির খবর হচ্ছে—কেউ শারীরিকভাবে আহত হননি। গাইড ও স্থানীয়দের দ্রুত সহায়তায় পুরো ইউনিটকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।
সজল বলেন:
“আমরা ভাবতেই পারিনি এমন কিছু হবে। সিনেমার জন্য বাস্তব লোকেশন চেয়েছিলাম, কিন্তু এতটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা... আজও গা শিউরে উঠছে।”
বুবলীও এই ঘটনা সম্পর্কে বলেন:
“মনে হচ্ছিল, এটাই আমার জীবনের শেষ দিন। এত কাছে থেকে বন্য হাতির চোখের দিকে তাকিয়েছি—ভয় যেন এখনো কাটেনি।”
বন বিভাগের বক্তব্য
এই বিষয়ে বন বিভাগের বান্দরবান শাখার কর্মকর্তারা জানান, উক্ত এলাকায় নিয়মিত বন্য হাতির চলাচল রয়েছে, বিশেষ করে গ্রীষ্মের শেষ দিকে তারা খাদ্য ও পানির সন্ধানে লোকালয়ের দিকে চলে আসে।
তাদের মতে, শুটিং ইউনিটটি যদি বন বিভাগের কাছ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে আসত, তাহলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। বন কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন:
“শুটিং ইউনিট আমাদের পূর্বে কিছুই জানায়নি। এই জায়গা হাতির করিডোর হিসেবে পরিচিত। এমন এলাকায় শুটিং করতে হলে বিশেষ সতর্কতা দরকার।”
চলচ্চিত্র পরিচালক কী বললেন?
সিনেমাটির পরিচালক রায়হান খান বলেন, “আমরা শুটিংয়ের আগে স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে লোকেশন যাচাই করেছিলাম। বন বিভাগের অনুমতির বিষয়টি স্থানীয় পর্যায়ে জেনেই গিয়েছিলাম। তবে ভবিষ্যতে আরও পেশাদার উপায়ে লোকেশন যাচাই করব।”
তিনি আরও বলেন, “শুটিং আমরা আপাতত স্থগিত করেছি। টিমের সবাই নিরাপদ আছে, এটাই বড় কথা।”
শুটিং ইউনিটের মধ্যে আতঙ্ক
এই ঘটনায় পুরো শুটিং ইউনিটের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে মানসিক চাপ ও ভয়। অনেকেই বলেন, তারা আর পাহাড়ি এলাকায় শুটিং করতে সাহস পাবেন না। ক্যামেরাম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন:
“আমার ক্যামেরাটা ভেঙে গেছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
কেন বাড়ছে হাতির আক্রমণ?
পরিবেশবিদরা বলছেন, বন উজাড়, কৃষি জমি সম্প্রসারণ ও পর্যটনের চাপের কারণে হাতির আবাসস্থল সংকুচিত হচ্ছে। ফলে তারা লোকালয়ে চলে আসে। হাতি সাধারণত শান্ত প্রাণী, কিন্তু মানুষের উপস্থিতি বা গন্ধে তারা ভয় পেয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে গত ৫ বছরে বন্য হাতির আক্রমণে মারা গেছেন অন্তত ৩০ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক।
নিরাপত্তার ঘাটতি ও করণীয়
এই ঘটনার আলোকে উঠে আসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন:
সিনেমার শুটিংয়ের আগে কি যথাযথ অনুমতি নেওয়া হয়?
সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর বন্যপ্রাণী চলাচল সম্পর্কে কি আগেই জানা যায়?
পরিবেশ ও প্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে শিল্পীরা কতটা সচেতন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন:
বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও শুটিং ইউনিটের সমন্বয় থাকা উচিত।
লোকেশন নির্ধারণে ওয়াইল্ডলাইফ ম্যাপ ব্যবহার করা উচিত।
শুটিং ইউনিটের সদস্যদের প্রাথমিক পরিবেশ সচেতনতা প্রশিক্ষণ থাকা দরকার।
বুবলীর সাহসিকতা ও বার্তা
এই ঘটনার পর বুবলী তার ফেসবুক পেজে একটি আবেগঘন পোস্ট দেন:
“আমরা যখন প্রকৃতিকে ব্যবহার করি, তার প্রতি দায়িত্বও নিতে হবে। আমি জীবিত আছি আল্লাহর রহমতে। কিন্তু যারা প্রতিনিয়ত এই বনাঞ্চলে বাস করেন, তারা কতটা বিপদের মধ্যে আছেন ভাবুন।”
এই পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং অনেকেই তার সচেতনতামূলক বার্তার প্রশংসা করেন।
উপসংহার
“সজল-বুবলীর নতুন সিনেমার শুটিংয়ে বন্যহাতির আক্রমণ” — এটি শুধুই একটি শুটিং দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি সতর্ক সংকেত। প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষকে বসবাস করতে হবে সহাবস্থানের ভিত্তিতে। সিনেমা, পর্যটন বা প্রকৃতি উপভোগ—সবকিছুরই সীমা ও দায়িত্ব আছে।
0 Comments