Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

বিদেশে স্বপ্নযাত্রার করুণ পরিণতি: সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল বাংলাদেশি যুবকের

 


ভূমিকা

প্রবাসী জীবন মানেই স্বপ্ন, সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ। দেশের মাটি ছেড়ে অন্য দেশে কর্মসংস্থানের খোঁজে যাওয়া লাখো বাংলাদেশির প্রতিদিনের জীবনে রয়েছে সুখ-দুঃখের নানা রকম গল্প। কেউ সফল হয়ে ফিরছেন, কেউ থেকে যাচ্ছেন অজানা-অচেনা দেশেই, আবার কেউ কেউ ফিরছেন লাশ হয়ে। তেমনই একটি মর্মান্তিক ঘটনায় প্রবাসে ঝরে গেল আরেকটি তাজা প্রাণ—সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন নোয়াখালীর যুবক সাইফুল ইসলাম।


ঘটনার বিবরণ

২০২৫ সালের ২৮ মে, বুধবার সকালে সৌদি আরবের তাবুক শহরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে নিজ গাড়িতে পানি তুলছিলেন। ঠিক সেই সময় একটি ভারী লরি এসে তাকে চাপা দেয়। দুর্ঘটনাটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

তার সহকর্মীদের বরাতে জানা যায়, সাইফুল ছিলেন একজন শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কাজ করতেন একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। যান্ত্রিক তাড়াহুড়োর এই শহরে নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময় এমন দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় প্রতি বছর বহু প্রবাসী এইভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন।


ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন

সাইফুল ইসলাম নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার কাদিরপুর ইউনিয়নের সাহেবেরহাট গ্রামের বাসিন্দা। তিনি চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। দেড় বছর আগে সৌদিতে যান রোজগারের আশায়। এর আগে তিনি প্রায় ১৩ বছর মিশরে ছিলেন। জীবনের বড় একটা সময় বিদেশেই কাটিয়েছেন সাইফুল। স্ত্রী ও একমাত্র দেড় বছর বয়সী সন্তানের জন্য নতুন করে স্বপ্ন গড়তে চেয়েছিলেন সৌদিতে।

তার পরিবারের সদস্যরা জানান, সাইফুল ছিলেন পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। তার পাঠানো টাকায় চলতো পরিবার। তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে গোটা পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মা বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, স্ত্রী বাকরুদ্ধ, আর ছোট্ট সন্তান কিছুই না বুঝে কাঁদছে মায়ের কোলেই।


সমাজ ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া

সাইফুলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। গ্রামের লোকজন ভিড় জমায় তার বাড়িতে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কাদিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, "এই মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়, এটি গোটা সমাজের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তার মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করবো।"


সরকারি সহায়তা ও দূতাবাসের ভূমিকা

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতি নিহতের পরিবারের অনুরোধ, যেন দ্রুত মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণত সৌদিতে এমন ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল হয়ে পড়ে। তবে দূতাবাস যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এই প্রক্রিয়া সহজ হয়। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা বিষয়টি দেখছেন এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় মরদেহ দেশে পাঠানো হবে।

সরকারিভাবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকেও পরিবারকে সহযোগিতার জন্য আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সাইফুলের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা যেন ক্ষতিপূরণ, প্রবাসী কল্যাণ ফান্ড এবং প্রবাসী বিমার টাকা পান। এ ছাড়া তার সন্তান যেন ভবিষ্যতে সরকারি সহায়তায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।


প্রবাসীদের জন্য নিরাপত্তার প্রশ্ন

এই মৃত্যুর পর আবারও সামনে এসেছে প্রবাসীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। যারা জীবন ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে কাজ করছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি সড়ক দুর্ঘটনা, কাজের সময় দুর্ঘটনা অথবা স্বাস্থ্য সমস্যায় প্রাণ হারাচ্ছেন।

বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সেখানে আইনি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সহায়তা নিশ্চিত করা। দূতাবাসগুলোকে হতে হবে আরও সক্রিয়, প্রবাসীদের প্রতিটি সমস্যা সম্পর্কে সচেতন এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম।


উপসংহার

সাইফুল ইসলামের মৃত্যু শুধুই একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি এক পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ, এক সমাজের বেদনার গল্প। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উঠে আসে প্রবাসীদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা। জীবনের সব আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে যেসব মানুষ দেশের মঙ্গলের জন্য বিদেশে কাজ করেন, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আমরা চাই সাইফুলের মতো আর কোনো যুবকের প্রাণ যেন প্রবাসের মাটিতে অকালে ঝরে না পড়ে। পরিবারগুলো যেন তাদের প্রিয়জনকে শুধুমাত্র ছবিতে না খোঁজে। আমরা চাই প্রতিটি প্রবাসী নিরাপদ থাকুক, সুস্থ থাকুক এবং ফিরে আসুক সফলতা নিয়ে।


স্মরণীয় বাক্য
“সাইফুলের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—স্বপ্ন পূরণের যাত্রা কতটা দুর্গম হতে পারে।”



Post a Comment

0 Comments