Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

নওগাঁয় স্ত্রীর হাত কেটে বিচ্ছিন্ন, স্থানীয়দের গণপিটুনিতে স্বামীর মৃত্যু — এক নারকীয় ঘটনার পূর্ণ বিবরণ

 


নওগাঁ সদর উপজেলার আনন্দনগর গ্রামে ঘটেছে এক নারকীয় ও হৃদয়বিদারক ঘটনা, যা গোটা এলাকাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পারিবারিক কলহের জেরে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে কুপিয়ে তার এক হাত সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর রক্তাক্ত পরিস্থিতি দেখে উত্তেজিত স্থানীয়রা হামলাকারী স্বামীকে ধরে ফেলে এবং বেধড়ক মারধর করে, যার ফলে পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি পরিবার নয়, গোটা সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।


 ঘটনার সূচনা

নওগাঁ সদর উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. সুমন আলী (৪০) ও তার স্ত্রী ময়ূরী খাতুন (৩৫) দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহে জর্জরিত ছিলেন। এলাকার লোকজন জানায়, প্রায় প্রতিদিনই তাদের মধ্যে বচসা চলত। কখনো গালিগালাজ, কখনো হাতাহাতি, আর মাঝেমধ্যে ময়ূরীর কান্নার শব্দ ভেসে আসত প্রতিবেশীদের কানে।

বুধবার সকাল ১০টার দিকে, চায়ের দোকান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর সুমন একটি ধারালো হাসুয়া দিয়ে হঠাৎ করে স্ত্রীর ওপর আক্রমণ চালায়। এই হামলা এতটাই হিংস্র ও আকস্মিক ছিল যে, ময়ূরী আত্মরক্ষার সুযোগ পর্যন্ত পাননি।


 নির্মমতা: একটি হাতের অবসান

প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে প্রতিবেশী রহিমা খাতুন বলেন,

“ময়ূরী বাঁচার জন্য চিৎকার করছিল। আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি, ওর বাম হাতটা শরীর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তে সয়লাব।”

সুমনের আঘাত এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এক কোপেই স্ত্রীর পুরো হাত কেটে পড়ে যায়। প্রতিবেশীরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জরুরি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা।


স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ও গণপিটুনি

এমন নৃশংসতা দেখে রাগে ফেটে পড়ে স্থানীয় জনতা। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল সংখ্যক মানুষ জমায়েত হয়ে যায় সুমনের বাড়ির সামনে। কেউ লাঠি, কেউ বাঁশ, কেউ আবার রড নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। এরপর শুরু হয় মারধর। প্রচণ্ড প্রহারে সুমন গুরুতর আহত হন।

স্থানীয় এক যুবক বলেন,

“আমরা আর সহ্য করতে পারিনি। নিজের বউকে কেউ কীভাবে এমনভাবে কোপাতে পারে! সে যা করেছে, তার জন্য এইটুকু শাস্তি কম।”

পরে পুলিশ এসে গুরুতর আহত অবস্থায় সুমনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।


 আহত ময়ূরীর অবস্থা

ময়ূরী বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা এখন স্থিতিশীল, তবে মানসিকভাবে সে চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। শারীরিক আঘাতের চেয়েও মানসিক আঘাত তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। হাত হারানো একজন নারীর জীবনে যে কতটা বেদনাদায়ক তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।


 সন্তানের চোখে সেই বিভীষিকা

এই দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে (৯) এবং ছোট মেয়ে (৫)। ঘটনার সময় বাড়িতে থাকলেও তারা আতঙ্কে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে পড়ে। পরে ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

“আব্বু আম্মুকে মারছিল। আমি অনেক চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আসছিল না। আম্মু শুধু বলতেছিল – ‘বাঁচাও’।”

এ ঘটনা শিশুদের মনোজগতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করছেন শিশু মনোবিজ্ঞানীরা।


পুলিশ ও প্রশাসনের বক্তব্য

নওগাঁ সদর থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন,

“ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও ভয়ঙ্কর। আমরা দুটি পৃথক মামলা নিচ্ছি— একটি স্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এবং আরেকটি গণপিটুনিতে স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায়। তদন্ত চলছে।”

তিনি আরও বলেন, এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়।


 সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ

এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, এই ধরনের ঘটনার জন্য নারীদের আত্মরক্ষার আইনজ্ঞান থাকা জরুরি। অন্যদিকে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?

মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর প্রতিনিধি সুলতানা পারভীন বলেন,

“এটা সত্য যে স্ত্রীর ওপর হামলা চরম নৃশংস। তবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা আইনত অপরাধ। এই দুই পক্ষই শাস্তিযোগ্য। রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে উভয় ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।”


পারিবারিক সহিংসতা: একটি ভয়াবহ বাস্তবতা

বাংলাদেশে প্রতি বছর শত শত নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। কোনো ক্ষেত্রে তা প্রকাশ পায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে তা চিরকাল গোপনই থেকে যায়। এই ঘটনার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক সহিংসতা কখনো কখনো মৃত্যুর পথ পর্যন্ত নিয়ে যায়।

সামাজিক গবেষক ড. ফারজানা হোসেন বলেন,

“নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে আমাদের সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, অসচেতনতা ও আইনের প্রয়োগহীনতা। এখন সময় এসেছে প্রতিটি পরিবারে সচেতনতা বৃদ্ধির।”


 উপসংহার

নওগাঁর এই মর্মান্তিক ঘটনাটি শুধু একটি পরিবারে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের জায়গায় জায়গা নিয়েছে হিংস্রতা ও অবিশ্বাস। যেখানে প্রতিবেশীরা জানতেন সমস্যা আছে, কিন্তু কেউ আগেভাগে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

একজন নারী তার হাত হারালেন, সন্তানরা হারাল নিরাপদ শৈশব, আর একজন পুরুষ হারাল জীবন। এই ধরনের ঘটনায় কেউই বিজয়ী নয়। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন—সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই পারিবারিক সহিংসতা রোধ করা সম্ভব।

Post a Comment

0 Comments