![]() |
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঈদ মানেই বড় বাজেটের তারকাখচিত সিনেমার মুক্তি এবং প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়া দর্শক। ২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবার ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পেল বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র ‘অন্তরাত্মা’, যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান এবং কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী দার্শনা বনিক।
চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন এবং প্রযোজনা করেছেন কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার সোহানী হোসেন। সিনেমাটি রোমান্টিক ঘরানার হলেও এতে পারিবারিক আবেগ, সামাজিক টানাপোড়েন, আত্মত্যাগ, এবং ভালোবাসার গভীর গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সিনেমার প্রেক্ষাপট ও কাহিনী সংক্ষেপ
‘অন্তরাত্মা’ সিনেমার গল্প আবর্তিত হয়েছে প্রেম, মানবিক সম্পর্ক, এবং ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ নিয়ে।
শাকিব খান অভিনীত চরিত্রটি একজন অভিজাত পরিবারের সন্তান, যার জীবন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একদিকে পরিবারিক দায়িত্ব, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন ও ভালোবাসা—এই দ্বন্দ্বে জর্জরিত তার মন। অন্যদিকে দার্শনা বনিক অভিনীত চরিত্রটি সাধারণ ঘরের শিক্ষিতা, সৎ, এবং আত্মমর্যাদাশীল মেয়ে, যে নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে চায়।
দুজন ভিন্ন জীবনবোধের মানুষের মধ্যে এক অনন্য ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেটি সমাজ, পরিবার ও অভ্যন্তরীণ দ্বিধার কারণে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সিনেমাটি সেই সম্পর্কের টানাপোড়েন, ত্যাগ, ও পুনর্মিলনের এক মর্মস্পর্শী উপস্থাপন।
অভিনয় ও চরিত্র বিশ্লেষণ
শাকিব খান তার ক্যারিয়ারের অন্যতম পরিণত এবং আবেগঘন অভিনয় দিয়েছেন এই চলচ্চিত্রে। ‘অন্তরাত্মা’-তে তাকে একজন আবেগপ্রবণ, দায়িত্ববান এবং দ্বিধাগ্রস্ত পুরুষ চরিত্রে দেখা গেছে, যা তার আগের বহু চরিত্র থেকে ভিন্ন। তার সংলাপ ও অভিব্যক্তি দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
দার্শনা বনিক বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো কাজ করলেন এবং তার অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। তার চরিত্রটি দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী এবং একই সঙ্গে আবেগপ্রবণ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি শুধু গ্ল্যামার নয়, অভিনয় দক্ষতাতেও সমান পারদর্শী।
সিনেমার অন্যান্য সহশিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন আলোচিত অভিনেতা মাসুম পারভেজ রুবেল, যিনি খল চরিত্রে অভিনয় করে আবারও প্রমাণ করেছেন কেন তিনি এক সময়ের ঢালিউডের সেরা ভিলেন ছিলেন। এছাড়া, জয়রাজ, সাবেরী আলম, ডি এ তায়েব, রাশেদ মামুন অপুসহ অন্যান্যরা পার্শ্ব চরিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
পরিচালনা ও নির্মাণ
পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমার মাধ্যমে আবারও তার পরিচালনাশৈলীর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। চিত্রনাট্যের গভীরতা, ক্যামেরার কাজ, সংলাপের ভারসাম্য এবং আবেগের প্রক্ষেপণ—সবকিছুতেই ছিল পরিপক্বতা।
তিনি সিনেমার গতি নিয়ন্ত্রণে দারুণ কাজ করেছেন। গল্প কখনো ধীর, কখনো দ্রুতগতির, কখনো রোমান্টিক, আবার কখনো আবেগঘন—সবকিছুর মধ্যে একটি সঠিক ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।
সংগীত ও সাউন্ডট্র্যাক
চলচ্চিত্রের গানগুলো সিনেমাটির আবেগময়তা বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমার মিউজিক কম্পোজ করেছেন দেশের খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক এমনেস রোমেল।
বিশেষ করে "তোমার ছায়া যেখানে" ও "হারিয়ে যেও না" গান দুটি ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে উঠেছে। গানে ব্যবহৃত কথা ও সুর সিনেমার আবেগ ও প্রেমের অনুভূতিকে আরও জোরালো করে তুলেছে।
চিত্রগ্রহণ ও প্রযুক্তিগত দিক
সিনেমার চিত্রগ্রহণ করেছেন শাহীন রিয়াজ, যিনি প্রাকৃতিক দৃশ্য, আভ্যন্তরীণ সেট ডিজাইন এবং রোমান্টিক মুহূর্তগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ক্যামেরায় বন্দি করেছেন।
সম্পাদনা, কালার গ্রেডিং, ভিএফএক্স—সবকিছুতেই একটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়েছে। বিশেষ করে প্রেম ও দ্বন্দ্বের দৃশ্যগুলোয় ক্যামেরার ব্যবহার সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
দর্শকদের প্রতিক্রিয়া
সিনেমাটি ঈদের দিন থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৭০টিরও বেশি হলে একযোগে মুক্তি পায় এবং প্রথম দিনেই হাউসফুল শো দেখা যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ বিভিন্ন বড় শহরে। দর্শকরা বলছেন, অনেকদিন পর একটি “ক্লাসিক ফ্যামিলি ড্রামা” দেখার সুযোগ পেলেন।
বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, ইউটিউব রিভিউ এবং ব্লগে দর্শকরা সিনেমাটির চিত্রনাট্য, গান, অভিনয় এবং নির্মাণের প্রশংসা করেছেন। অনেকেই বলছেন, এটি শাকিব খানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হতে পারে।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
‘অন্তরাত্মা’ শুধুমাত্র একটি ঈদের সিনেমা নয়, এটি নতুন প্রজন্মের বাংলা সিনেমার একটি প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে, ভালো কাহিনী, চমৎকার অভিনয় এবং মানসম্পন্ন নির্মাণ থাকলে বাংলাদেশের সিনেমা এখনও মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম।
এই সিনেমার সাফল্য অন্য নির্মাতাদেরও অনুপ্রাণিত করবে মৌলিক গল্প এবং ভালো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে। আশা করা যায়, ‘অন্তরাত্মা’ বাংলা চলচ্চিত্রের একটি "মাইলফলক" হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
উপসংহার
‘অন্তরাত্মা’ একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া প্রেম ও পারিবারিক গল্পের সফল চিত্ররূপ। এটি কেবল একটি সিনেমা নয়, বরং একজন দর্শকের অন্তরের কথাকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার এক অনন্য প্রয়াস। ঈদে পরিবারের সবাইকে নিয়ে হলে গিয়ে এই সিনেমা উপভোগ করা নিঃসন্দেহে একটি মনোরম অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে।
0 Comments