ভূমিকা:
২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার সকালবেলা টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার মুলিয়া এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই দুইজন প্রাণ হারান এবং আহত হয় কমপক্ষে ১০ জন যাত্রী। স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা চালায়। দুর্ঘটনাটি এলাকা জুড়ে চরম উদ্বেগ ও শোকের ছায়া নেমে আসে।
ঘটনার বিবরণ:
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সকাল ৭টার দিকে টাঙ্গাইল শহর থেকে ছেড়ে আসা একটি যাত্রীবাহী বাস ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। কালিহাতী উপজেলার মুলিয়া এলাকায় পৌঁছালে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং বাসটি রাস্তার পাশে গভীর খাদে পড়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতি ও চালকের অসতর্কতা এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
খাদে পড়ে যাওয়ার পরপরই বাসটি একটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা খায় এবং খুঁটির সঙ্গে সংযুক্ত একটি বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে বাসের উপর পড়ে যায়। এতে একজন যাত্রী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। অপর যাত্রী নিহত হন বাসের ধাক্কায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে।
নিহত ও আহতদের পরিচয়:
দুইজন নিহত ব্যক্তির মধ্যে একজনের নাম মোঃ আবুল হোসেন (৫২), যিনি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বাসিন্দা। অপর নিহত ব্যক্তি অজ্ঞাত পরিচয়ের, তবে স্থানীয়রা ধারণা করছেন তিনি একজন ভ্রাম্যমাণ ফল বিক্রেতা ছিলেন।
আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদেরকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, বেশ কয়েকজনের শরীরে গুরুতর আঘাত রয়েছে এবং দুইজনকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।
উদ্ধার তৎপরতা:
দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় বাসিন্দারা ছুটে এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। পরে টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, কালিহাতী থানা পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেন। রেসকিউ টিম বাসের ছাদ কেটে আটকে থাকা যাত্রীদের বের করে আনেন।
ঘটনার পরপরই টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং রাস্তা স্বাভাবিক হয়।
প্রাথমিক কারণ ও তদন্ত:
পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগ প্রাথমিকভাবে মনে করছে, চালকের অসতর্কতা, বাসের অতিরিক্ত গতি এবং রাস্তার বাঁকটি বিপজ্জনক হওয়াই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তবে সঠিক কারণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, “আমরা দুর্ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করছি। বাসটির মালিক ও চালকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য:
প্রত্যক্ষদর্শী আশরাফুল ইসলাম জানান, “আমি রাস্তার পাশে দোকানে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি বাসটি হর্ণ বাজাতে বাজাতে দ্রুত গতিতে আসছে। এক পর্যায়ে বাঁক ঘোরার সময় বাসটি হেলে পড়ে যায় এবং সোজা খাদে গিয়ে পড়ে। খুব ভয়াবহ একটা দৃশ্য ছিল, তখনই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।”
জেলা প্রশাসনের পদক্ষেপ:
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিহতদের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসার সব ব্যয় জেলা প্রশাসন বহন করছে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, “এই ধরনের ঘটনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে, সে জন্য পরিবহন মালিক ও চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া:
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই সড়ক নিরাপত্তা ও গণপরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা তুলে ধরেছেন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জানান, “সড়ক দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। নিয়ম ভঙ্গকারী চালকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
সড়ক নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ করণীয়:
এই দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট উন্নত হয়নি। দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো হল:
অদক্ষ বা অনভিজ্ঞ চালক
যানবাহনের নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা না হওয়া
অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং প্রবণতা
দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে চালকদের প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, রাস্তাঘাটের মানোন্নয়ন, এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
উপসংহার:
টাঙ্গাইলের এই বাস দুর্ঘটনা আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিল যে, নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে যে শুধু একটি জীবন নয়, পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই মানবিক দিকটি চিন্তা করে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। এ জাতীয় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার, পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ জনগণকে একসাথে কাজ করতে হবে।
0 Comments