Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

লক্ষ্মীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২, আহত ১: নিরাপত্তাহীন সড়কের নির্মম বাস্তবতা

 


লক্ষ্মীপুর, ২৫ মে ২০২৫ — লক্ষ্মীপুর জেলার দুটি ভিন্ন স্থানে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই জন, আহত হয়েছেন আরও একজন। সকালবেলায় ঘটে যাওয়া এই দুটি দুর্ঘটনা জেলার জনগণকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবের কারণে প্রাণ ঝরছে সাধারণ মানুষের, অথচ প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়।

দুর্ঘটনা ১: কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় ভ্যানচালক নিহত

প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের পিয়ারাপুর নামক স্থানে। সকাল আনুমানিক ৮টা ৩০ মিনিটে ভ্যানচালক নজরুল ইসলাম কামাল (৫০) তাঁর ব্যাটারিচালিত ভ্যানে করে ভবানীগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন। বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসা একটি কাভার্ড ভ্যানের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। স্থানীয়রা দ্রুত ছুটে এসে একজন আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাভার্ড ভ্যানটি অতিমাত্রায় গতি নিয়ে চলছিল এবং চালক নিয়ন্ত্রণ হারান, ফলে ভ্যানে সজোরে ধাক্কা লাগে। নিহত নজরুল ইসলাম স্থানীয়ভাবে একজন পরিচিত ও প্রিয় মানুষ ছিলেন। তাঁর এই অকাল মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

দুর্ঘটনা ২: রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় নিহত পথচারী

একই দিন দুপুরের দিকে দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটে লক্ষ্মীপুর-ঢাকা মহাসড়কের কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সামনে। একজন অজ্ঞাতনামা পথচারী সড়ক পার হওয়ার সময় একটি দ্রুতগামী ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পুলিশ এখনো তার পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি।

এই স্থানটি অতীতেও দুর্ঘটনার জন্য পরিচিত। আশেপাশে কোনো স্পিড ব্রেকার বা পথচারী পারাপারের নিরাপদ ব্যবস্থা না থাকায় এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে।

পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা

উভয় দুর্ঘটনায় লক্ষ্মীপুর সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায় এবং দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখছে। পুলিশ জানায়, কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক দুটিকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সহায়তায় চালকদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতি এবং অসাবধানতা এই দুর্ঘটনার মূল কারণ। এছাড়াও দুর্ঘটনার সময় কোনো ট্রাফিক পুলিশ বা নিয়মতান্ত্রিক সড়ক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকাও অন্যতম কারণ।

সড়ক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও জনভোগান্তি

লক্ষ্মীপুর জেলার প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারহীন গর্তযুক্ত রাস্তা, অপরিকল্পিত বাঁক ও চিহ্নহীন পারাপার পথ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ফুটপাত নেই, ফলে পথচারীদের রাস্তার মাঝ দিয়ে চলাচল করতে হয়। এ ছাড়া ট্রাফিক সিগন্যাল, সিসিটিভি ক্যামেরা, রোড সেফটি সাইনেজ — এই সব উপকরণও তেমনভাবে দেখা যায় না। এর পাশাপাশি বেপরোয়া চালক ও লাইসেন্সবিহীন যানবাহনের আধিক্য দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জনগণের প্রতিক্রিয়া ও দাবি

নিহতদের পরিবার ও স্থানীয় জনসাধারণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু প্রশাসনের তেমন কোনো নজর নেই। প্রতিবার কয়েক দিন আলোচনায় আসে, তারপর আবার সব আগের মতো।"

তাঁরা দাবি জানান, জেলা প্রশাসন ও সড়ক বিভাগকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে — যেম

স্পিড ব্রেকার স্থাপন

পথচারী পারাপার ব্যবস্থা উন্নতকরণ

চালকদের ট্রেনিং ও লাইসেন্স যাচাই

নিয়মিত ট্রাফিক মনিটরিং

বেপরোয়া যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ

বিশ্লেষকদের মতামত

সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, "সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ হলো অব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতার অভাব। চালকদের প্রশিক্ষণ, সঠিক লাইসেন্সিং, যন্ত্রচালিত যানবাহনের নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষার অভাব — এগুলোই প্রধান সমস্যা। এর সঙ্গে যদি সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতাও যুক্ত হয়, তাহলে দুর্ঘটনা অনিবার্য।"

তাঁরা বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমবে না।

সমাধান কোথায়?

লক্ষ্মীপুরের এই সাম্প্রতিক দুটি সড়ক দুর্ঘটনা আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত। প্রতিনিয়ত মানুষ জীবন হারাচ্ছে, পরিবারগুলো সর্বস্ব হারাচ্ছে — অথচ দায় কেউ নিচ্ছে না।

এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো:

টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ

আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনা

গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ

স্থানীয় জনসচেতনতা বৃদ্ধি

এবং সর্বোপরি, কঠোর আইন প্রয়োগ

উপসংহার

লক্ষ্মীপুরে ২৫ মে ২০২৫ তারিখে ঘটে যাওয়া এই দুটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা শুধুই সংখ্যা নয়, এটি দুটো পরিবারকে চিরতরে ভেঙে দিয়েছে। একজন সাধারণ ভ্যানচালক এবং এক পথচারী — যাদের অপরাধ শুধুই রাস্তায় চলা। আমাদের উচিত, এমন মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করে তা প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

জনগণের জীবন যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে উন্নয়ন কতটা বাস্তব — এই প্রশ্নের উত্তর সরকার ও প্রশাসনের খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।

Post a Comment

0 Comments