ভূমিকা
সড়ক দুর্ঘটনা আজকের বাংলাদেশে একটি দুঃসহ ও নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হয় প্রাণ হারানো সাধারণ মানুষদের করুণ ঘটনা। ২০২৫ সালের ২৪ মে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় এমনই একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে একটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন এক নিরীহ মোটরসাইকেল আরোহী — মোহাম্মদ শাহজাহান। এই ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের দেশের সড়ক অব্যবস্থাপনা, সচেতনতার অভাব ও নিয়ন্ত্রণহীন গতি ব্যবস্থার এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
ঘটনার বিবরণ
২০২৫ সালের ২৪ মে, শনিবার সকাল আনুমানিক ৮টা নাগাদ চকরিয়া উপজেলার বানিয়ারছড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ঘটে যায় এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। নিহত মোহাম্মদ শাহজাহান (৩৮) পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে একজন পরিচিত মুখ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শাহজাহান মোটরসাইকেলে করে চকরিয়া শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় একটি দ্রুতগতির কাভার্ড ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ধাক্কাটি এতটাই তীব্র ছিল যে ঘটনাস্থলেই শাহজাহান মারাত্মকভাবে আহত হন। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান, কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের পরিচয় ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট
নিহত মোহাম্মদ শাহজাহান ছিলেন কক্সবাজার জেলার একজন সজ্জন, পরিশ্রমী ব্যক্তি। তার বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর এবং তিনি দুই সন্তানের জনক ছিলেন। পরিবারের জন্য তিনি ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে গভীর শোক আর অনিশ্চয়তা।
শাহজাহানের স্ত্রী এক অসহায় কান্নায় সাংবাদিকদের বলেন, “আমার স্বামী আর নেই, আমার ছোট ছোট দুই সন্তান কীভাবে বড় হবে? কে তাদের দেখবে এখন?”
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ
এই দুর্ঘটনা শুধুমাত্র একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, বরং এটি তুলে ধরেছে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোর নিরাপত্তার ভয়াবহ দুরবস্থা। শাহজাহানের মৃত্যুর জন্য কয়েকটি কারণ বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে:
অতিরিক্ত গতি ও নিয়ন্ত্রণহীন ড্রাইভিং:
কাভার্ড ভ্যানটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছিল এবং চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণই হচ্ছে এই অতিরিক্ত গতি ও অনিয়ন্ত্রিত ড্রাইভিং।
পেশাদার চালকের অভাব ও অদক্ষতা:
অনেক কাভার্ড ভ্যান চালক পেশাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাস্তায় নামেন, যা বড় ধরনের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
নিয়ন্ত্রণহীন মালবাহী যানবাহন চলাচল:
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচুর সংখ্যক ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। কোনো নির্দিষ্ট নিয়মকানুন বা গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় এসব যানবাহন মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
ট্রাফিক পুলিশের তদারকির ঘাটতি:
বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে, যার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।
প্রতিক্রিয়া ও স্থানীয়দের ক্ষোভ
স্থানীয় জনসাধারণ এই ঘটনার পর মহাসড়কে বিক্ষোভ করেন এবং দ্রুত কাভার্ড ভ্যানের চালককে আটক ও বিচারের দাবি জানান। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, "এই রাস্তায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু প্রশাসনের নজর পড়ে না। আমরা কত প্রাণ হারালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে?"
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, কাভার্ড ভ্যানটি আটক করা হয়েছে এবং চালককে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে করণীয়
এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার ও সড়ক কর্তৃপক্ষের সচেতনতা এবং কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উল্লেখ করা হলো:
স্মার্ট স্পিড লিমিটার ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন:
ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে স্পিড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত।
ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা:
পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নিয়মিত ভেহিকল ইনস্পেকশন:
কাভার্ড ভ্যানসহ সকল যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় আনা জরুরি।
ট্রাফিক পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি:
মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টা ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
স্থানীয়দের অংশগ্রহণ:
দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে সড়ক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
উপসংহার
মোহাম্মদ শাহজাহানের করুণ মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি একটি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি আরও কার্যকর না হয়, তাহলে এমন বহু শাহজাহানকে আমরা হারাতে থাকব। আমাদের এখনই সময় জেগে ওঠার, আমাদের রাস্তা ও রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার।
একটি উন্নত ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে আমাদের সবারই দায়িত্ব সড়ক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রশাসন, সড়ক কর্তৃপক্ষ, চালক, যাত্রী — সবাই মিলে গড়ে তুলতে হবে একটি নিরাপদ মহাসড়ক।
0 Comments