Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

আলুর রেকর্ড উৎপাদনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই — দাম নেই, বিপাকে দেশের হাজারো চাষি


 বাংলাদেশের কৃষিখাতে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে চলেছে — চলতি ২০২5 সালের মওসুমে আলুর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। দেশের প্রধান আলু উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো যেমন বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এবং ময়মনসিংহে অভাবনীয় হারে ফলন হয়েছে। তবে শঙ্কার বিষয় হলো, এই রেকর্ড উৎপাদনের মধ্যেও কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কারণ, উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারমূল্য আশঙ্কাজনকভাবে কম, যার ফলে কৃষকের পুঁজি ফেরত আসছে না, বরং লোকসান গুনতে হচ্ছে।


রেকর্ড উৎপাদন: আকাশছোঁয়া পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১২% বেশি। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতের আলুর ফলন ভালো হওয়ায় জমির প্রতি হেক্টরে উৎপাদন বেড়েছে গড়ে ২-৩ টন।

বগুড়ার একজন চাষি হাবিবুর রহমান জানান, “গত বছর প্রতি হেক্টরে ২২-২৩ টন পেয়েছিলাম, এবার ২৫ টনের বেশি উঠেছে।” তবে এই বাড়তি ফলনের আনন্দ বেশি দিন টিকেনি, কারণ বাজারে দাম একেবারেই পড়ে গেছে।



কৃষকের বর্তমান বাস্তবতা: লোকসানের হিসাব

চাষাবাদের জন্য একজন কৃষকের প্রধান খরচের জায়গাগুলো হলো: বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, শ্রম ও ভাড়া। গড়ে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়ে ১২-১৩ টাকা। অথচ এই মুহূর্তে বিভিন্ন হাটবাজারে আলুর বিক্রয়মূল্য ৬-৮ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের চাষি মিজানুর রহমান বলেন, “১ লাখ টাকা খরচ করে আলু চাষ করেছিলাম। বিক্রি করে এখনো ৭০ হাজার টাকাও আসেনি। আলুর এই বাজারে তো শুধু লোকসান।”

এছাড়া সংরক্ষণের খরচ, হিমাগারের মজুরি, এবং পরিবহণ খরচ ধরলে ক্ষতির অঙ্ক আরও বাড়ে। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে আলু ক্ষেতেই নষ্ট হতে দিচ্ছেন, কারণ খরচ দিয়ে তুললে আরও ক্ষতি।


বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা: মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট

একদিকে কৃষক উৎপাদন করছেন, অন্যদিকে বাজারে দাম স্থির থাকছে না। কেন এমন হচ্ছে?

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আলু বাজারে বড় সমস্যা হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ। হিমাগার মালিক, আড়তদার ও পাইকারদের একচেটিয়া প্রভাবের কারণে কৃষক তার ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এছাড়া বাজারে সরকারের তেমন কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ নেই।

সরকার ২০২৫ সালের শুরুতে আলুর জন্য নির্ধারিত মূল্য নির্ধারণ করেছিল (খুচরা ১২ টাকা, পাইকারি ১০ টাকা)। কিন্তু বাস্তবে এই নীতিমালা মাঠে নামানো যায়নি।

সরকারের করণীয় ও উদ্যোগ

বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে। কৃষিমন্ত্রী এক বক্তব্যে বলেন, “আমরা হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করছি এবং সরকারি ক্রয়ের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।”

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ঘোষণা নয়, বাস্তবায়ন জরুরি। সরকার যদি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে আলু ক্রয় করে সংরক্ষণ করে বা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করে, তাহলে কৃষকের ঘাড় থেকে লোকসানের চাপ অনেকটাই কমবে।


রপ্তানির সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশ প্রতিবছর ১-২ লাখ টন আলু রপ্তানি করলেও এ বছরের উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি আরও বাড়ানোর সুযোগ ছিল। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের আলুর চাহিদা রয়েছে। তবে রপ্তানিতে একাধিক সমস্যা রয়েছে:

কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও সনদপত্র ঘাটতি

প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সীমাবদ্ধতা

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা

তবুও অনেক কৃষি অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আলু প্রক্রিয়াজাত করে চিপস, স্টার্চ, ফ্রোজেন ফুড ইত্যাদির মাধ্যমে রপ্তানি করলে দেশের কৃষকের লাভ বাড়ানো সম্ভব।


কৃষকের আকুতি

সারা দেশের কৃষকদের একটাই কথা—“আমাদের পেটে ভাত উঠবে কি না, সেটা নির্ভর করে আলুর দামে।” একজন কৃষক রংপুর থেকে বলেন, “প্রতি বছরই একই সমস্যা হয়। ফলন ভালো হলেই দাম পড়ে। ক্ষেতে খেতে খেয়ে মরতে হবে নাকি?”

তাদের দাবি:

সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা

দ্রুত সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়

বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ

প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা

রপ্তানি খাতে সহজতর অনুমোদন প্রক্রিয়া


উপসংহার

বাংলাদেশের কৃষকরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাজারব্যবস্থার দুর্বলতা, নীতির বাস্তবায়নহীনতা এবং সরাসরি বাজার সংযোগ না থাকায় তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০২৫ সালের আলুর রেকর্ড উৎপাদন এর স্পষ্ট উদাহরণ।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার, যেখানে উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজার ব্যবস্থা এবং রপ্তানির মধ্যেকার সমস্ত পর্যায়ে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে।



Post a Comment

0 Comments