Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

রংপুরে গ্রীষ্মকালীন সবজির ভালো ফলন: কৃষকের মুখে হাসি, বাজারে দামে তৃপ্তি ভয়াবহতা


 রংপুর, বাংলাদেশ — দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরে এ বছর গ্রীষ্মকালীন সবজির চাষে লক্ষণীয় সাফল্য এসেছে। প্রাকৃতিক অনুকূল আবহাওয়া, কৃষকদের পরিশ্রম এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগে ফলন যেমন বেড়েছে, তেমনি বাজারেও সবজির দাম পাওয়া যাচ্ছে ভালো। ফলে কৃষকদের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি, আর স্থানীয় বাজারেও এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য।


 চাষ হয়েছে যে সবজি:

এবার রংপুর অঞ্চলে ব্যাপক হারে চাষ হয়েছে গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন সবজির, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

শসা,ঝিঙ্গা,করলা,কাঁচামরিচ,লাউ,পুঁইশাক,ঢেঁড়স,কাঁকরোল,চিচিঙ্গা,কচুবরবটি

বিশেষ করে রংপুর সদর, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলায় এসব সবজির চাষ চোখে পড়ার মতো।


 অনুকূল আবহাওয়া ও সেচ সুবিধা

এ বছর রংপুরে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও সূর্যপ্রকাশের সামঞ্জস্য বজায় ছিল। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, আগাম গ্রীষ্মে পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং পরে কয়েক দফা হালকা বৃষ্টিতে জমির আর্দ্রতা বজায় ছিল। অনেক কৃষক এবার সেচের জন্য গভীর নলকূপ ও সোলার পাম্প ব্যবহার করেছেন। এতে পানি সাশ্রয় হয়েছে এবং খরচও কমেছে।


 

কৃষকের পরিশ্রম ও উৎপাদন

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার চাষি মোঃ শাহজাহান বলেন,

“এই বছর আমি দুই বিঘা জমিতে করলা আর কাঁচামরিচ লাগিয়েছি। ফলন অনেক ভালো হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে ১৫-২০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করতে পারছি।”

অন্যদিকে, পীরগাছার চাষি রতন মিয়া জানান,

“আমি শসা আর ঝিঙ্গা চাষ করেছি। বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় পাইকাররা ক্ষেত থেকেই কিনে নিচ্ছে।”

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গ্রীষ্মকালীন সবজির আবাদ হয়েছে প্রায় ৮৫০০ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১২% বেশি। গড় ফলনও বেড়েছে প্রতি হেক্টরে ১৫-২০%।


বাজারে ভালো দাম

এই সাফল্যের আরেকটি দিক হলো বাজারে সবজির ভালো দাম। পাইকারি বাজারে যেমন চাহিদা বেশি, তেমনি খুচরা বাজারেও সবজির সরবরাহ ও মূল্য দুটোই কৃষক ও ভোক্তা—উভয়ের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

সবজিপাইকারি দাম (টাকা/কেজি)খুচরা দাম (টাকা/কেজি)
করলা৫০-৬০৬৫-৭৫
শসা৩০-৩৫৪৫-৫০
ঝিঙ্গা৩৫-৪০৫০-৫৫
কাঁচামরিচ৯০-১০০১১০-১২০
ঢেঁড়স৪০-৪৫৫৫-৬০

এই দামগুলো মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রংপুর শহরের শাপলা চত্বর ও মেডিকেল মোড় বাজারে সংগ্রহ করা হয়েছে।


পরিবহন ও বিপণনে সহায়তা

রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও স্থানীয় কিছু এনজিও এবার কৃষকদেরকে সরাসরি বাজারে সবজি পৌঁছাতে পরিবহন সুবিধা দিয়েছে। সেই সঙ্গে রংপুর কৃষি অফিস কৃষকদের বিভিন্ন বাজারের তথ্য দিয়ে তাদের সিদ্ধান্তে সহায়তা করেছে।

অনেকে এবার মোবাইল অ্যাপ বা কৃষিপণ্য অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছেন। এতে মধ্যস্বত্বভোগী কমছে, কৃষক পাচ্ছেন ন্যায্যমূল্য।


 চ্যালেঞ্জও আছে কিছু

তবে সবকিছুর মাঝেও কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন:

হঠাৎ অতিবৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টির ঝুঁকি

কিছু এলাকায় পোকামাকড়ের আক্রমণ

বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী

পাকা রাস্তার অভাব ও ফ্রেশ পণ্য পরিবহনে সমস্যা

মিঠাপুকুরের কৃষক আজিজুল হক বলেন,

“ফসল ভালো হলেও বাজারে ন্যায্যমূল্য পেতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক সময় ফড়িয়ারা দাম কমায়।”


সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ হুমায়ুন কবির জানান,

“আমরা কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ, বালাই নিয়ন্ত্রণ, জৈব সার ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ফলে তারা অনেক সচেতন হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, সরকার কৃষি প্রণোদনার অংশ হিসেবে বীজ, সার ও কীটনাশকে ভর্তুকি দিয়েছে। এছাড়া, প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও মোবাইল কৃষি পরামর্শ কার্যক্রম চালু রয়েছে।


পরিবেশবান্ধব কৃষির প্রচলন

রংপুর অঞ্চলে অনেক কৃষক এখন জৈব পদ্ধতিতে চাষ করছে। তারা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে গোবর, ভার্মি কম্পোস্ট ও প্রাকৃতিক বালাই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।

জৈব সবজি হওয়ায় বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। রংপুর শহরের “জৈব বাজার” নামক একটি উদ্যোগে এমন সবজি আলাদা দামে বিক্রি হচ্ছে।


ভোক্তার অভিমত

স্থানীয় ক্রেতা লায়লা বেগম বলেন,

“এবার বাজারে সবজি টাটকা ও স্বাদে ভালো। দাম একটু বেশি হলেও মানে আমরা সন্তুষ্ট।”

অন্যদিকে, একজন দোকানি জানান,

“সবজি বেশি আসছে, তবে গুণগত মান ভালো থাকায় চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে করলা আর কাঁচামরিচ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।”


ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

রংপুরের গ্রীষ্মকালীন সবজি এখন শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, বরং ঢাকাসহ দেশের বড় বড় বাজারেও সরবরাহ হচ্ছে। কিছু কিছু কৃষক ও সমবায় প্রতিষ্ঠান বিদেশে সবজি রপ্তানির দিকেও নজর দিয়েছে।

এই সফলতা ধরে রাখতে হলে চাই:

অব্যাহত কৃষি সহায়তা

পাকা রাস্তা ও সংরক্ষণ সুবিধা

কৃষক-ভোক্তার সরাসরি সংযোগ

আরও প্রশিক্ষণ ও বাজার বিশ্লেষণ


 উপসংহার

রংপুরের কৃষকেরা এবার গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষে সফলতা এনে দিয়েছেন যা পুরো দেশের জন্যই একটি ভালো দৃষ্টান্ত। তারা প্রমাণ করেছেন যে পরিশ্রম, সচেতনতা ও সঠিক পরিকল্পনায় কৃষিই হতে পারে টেকসই অর্থনীতির মূলভিত্তি। তাদের এই সাফল্য যদি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভিত আরও শক্তিশালী হবে।

Post a Comment

0 Comments