ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের মে মাসে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার একটি মন্তব্য। তিনি সরাসরি বাংলাদেশের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, “যদি বাংলাদেশ ভারতের ‘চিকেনস নেক’ করিডোরে আঘাত হানার চেষ্টা করে, তবে ভারতও বাংলাদেশের ‘উত্তর ও দক্ষিণ করিডোর’ লক্ষ্য করবে।”
এই বক্তব্যটি শুধু একটি কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিতরে একটি গভীর আস্থার সংকটের ইঙ্গিতও বহন করে। চলুন বুঝে নিই, কী এই ‘চিকেনস নেক’, কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই মন্তব্যের পেছনে কী ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা কাজ করছে।
কী এই ‘চিকেনস নেক’?
‘চিকেনস নেক’ বলতে বোঝানো হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলার মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ডকে। এটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর (আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মনিপুর ও অরুণাচল) সঙ্গে সংযুক্ত রেখেছে।
এই করিডোরটির প্রস্থ মাত্র ২২ কিলোমিটার।
এটিকে সামরিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল ধরা হয়।
এই অঞ্চলটি ভারতের জন্য 'লাইফলাইন' বা 'জীবন রেখা' হিসেবে পরিচিত।
যদি কোনো শত্রু পক্ষ এই অঞ্চলটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে, তাহলে উত্তর-পূর্ব ভারত মূল ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
উত্তেজনার সূত্রপাত
এই সাম্প্রতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি পুরাতন বিমানঘাঁটি পুনঃচালুর প্রকল্প। জানা গেছে, এই প্রকল্পে চীনের কারিগরি সহায়তা রয়েছে, এবং ভারত তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ভারত সরকার আশঙ্কা করছে, যদি চীন বাংলাদেশের এই ঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ পায়, তবে এটি ভারতের 'চিকেনস নেক' করিডোরের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি হতে পারে।
অতীতে ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বহুবার বলেছেন, চীন তার "স্ট্রিং অফ পার্লস" নীতির মাধ্যমে ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলতে চায়। বাংলাদেশের লালমনিরহাটে চীনের পদচারণা সেই নীতিরই একটি অংশ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মন্তব্য
তিনি বলেছেন:
“চিকেনস নেক যদি আক্রমণের লক্ষ্য হয়, তাহলে বাংলাদেশকেও সচেতন থাকতে হবে, কারণ আমরাও জানি কোথায় বাংলাদেশের চিকেনস নেক।”
এই বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় করিডোরগুলোর দিকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট করিডোরের মতো অঞ্চল—যেমন যশোর থেকে মংলা, বা উত্তরবঙ্গের তিস্তাপার—এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে আলোচনায় আসছে।
ভারতের উদ্বেগ কেন?
চীনের সক্রিয়তা: চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্র বন্দর।
চিকেনস নেক করিডোরে চীনের নজর ভারতকে কৌশলগতভাবে চাপে ফেলে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন ভারতের কিছু রাজনৈতিক মহল মনে করছে, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো চীনের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়ছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশ সরকার এখনও এই ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ একটি “ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক নীতি” অনুসরণ করছে – যেখানে চীন ও ভারতের উভয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে, বৈরিতা কারও সঙ্গে নয়’ – এই দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
বিশ্লেষণ ও মতামত
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা:
ভারতের উত্তরের সীমান্ত, বিশেষ করে সিকিম ও অরুণাচলে চীনের আগ্রাসী মনোভাব রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী যেকোনো কৌশলগত স্থাপনা ভারতের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অবকাশ বা সমাধান:
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এই ইস্যু নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হওয়া জরুরি।
সামরিক উত্তেজনা বা উগ্র বক্তব্য কেবল উভয় পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে।
উপসংহার
ভারতের 'চিকেনস নেক' করিডোরকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে তা কেবল একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ডকে ঘিরে নয়, বরং বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিকে স্পর্শ করছে। এটি চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের কৌশলগত ভারসাম্যের একটি পরীক্ষা।
সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক সংলাপ এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এই উত্তেজনার সমাধান খোঁজা না গেলে ভবিষ্যতে এটি আরও বড় জটিলতার দিকে যেতে পারে। বাংলাদেশের উচিত হবে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে হলেও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে এগোনো।
0 Comments