আড়িয়াল খাঁ নদে যৌথবাহিনীর অভিযান: নদী রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে অসংখ্য নদ-নদী দেশের ভূগোল এবং অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ দেশের প্রাণ হিসেবে খ্যাত অনেক নদী আজ নানা কারণে সংকটাপন্ন। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো আড়িয়াল খাঁ, যা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ এবং এর মাধ্যমে ভাঙ্গা ও সদরপুর উপজেলায় যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেআইনি বালু উত্তোলন ও ড্রেজিংয়ের কারণে নদীটির প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, নদীর পাড় ভাঙছে, এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সম্প্রতি আড়িয়াল খাঁ নদে একটি যৌথ অভিযান চালায় প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং পুলিশ।
২০২৫ সালের ২১ জুন রাতে শুরু হওয়া এ অভিযান ছিল একটি সমন্বিত কার্যক্রম, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী একযোগে অংশগ্রহণ করে। রাত ১১টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে সকাল ৬টা পর্যন্ত এ অভিযান চালিয়ে মোট ছয়টি অবৈধ ড্রেজার জব্দ করা হয় এবং তিনজনকে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন ফরিদপুর জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের একটি বিশেষ দল এবং পুলিশের সদস্যরা।
এ ধরনের অভিযানকে প্রশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছে। নদী থেকে বেআইনিভাবে বালু উত্তোলন শুধুমাত্র নদীর সৌন্দর্যহানিই করে না, এটি নদীটির স্বাভাবিক জলপ্রবাহকেও ব্যাহত করে এবং নদী ভাঙনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। নদী ভাঙনের ফলে অনেক পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারায়, অনেক কৃষি জমি নদীগর্ভে চলে যায়, এবং এই পরিস্থিতি স্থানীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
অভিযান শেষে জেলা প্রশাসক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমরা নদী রক্ষায় বদ্ধপরিকর। এ ধরনের বেআইনি কার্যকলাপ বন্ধ করতে প্রশাসন কঠোর ভূমিকা রাখবে। আগামী দিনগুলোতেও এ ধরনের অভিযান চলবে এবং যারা বেআইনিভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে নদীর ভারসাম্য নষ্ট করছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।” তার এ মন্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে প্রশাসন এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
অভিযানে আটক তিনজনকে সঙ্গে সঙ্গে থানায় সোপর্দ করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া জব্দকৃত ছয়টি ড্রেজার আইনানুযায়ী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি এবং তদন্তের ভিত্তিতে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতেও কাজ করছে পুলিশ।
এদিকে, স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রাতে নদী থেকে বালু তুলে নদীর পাড় ভাঙনের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছিল। অনেক কৃষক এবং নদীসংলগ্ন বাসিন্দা এ পরিস্থিতির কারণে আতঙ্কিত ছিলেন এবং প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেছিলেন যেন এ ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করা হয়। এবার অভিযান হওয়ায় তারা অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছেন এবং আশাবাদী যে এ অভিযানগুলো নিয়মিতভাবে চললে নদীটির অস্তিত্ব এবং পরিবেশ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এ ধরনের অভিযান কেবল একটি শুরু মাত্র। প্রকৃত অর্থে নদীর ভারসাম্য রক্ষায় একটি স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে নদীর পাড়ে বৃক্ষরোপণ, নদীর গভীরতা এবং প্রবাহ ধরে রাখতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ড্রেজিং, এবং নদী সুরক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। নদী দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
অপরদিকে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল অভিযান চালিয়ে বেআইনি কার্যক্রম বন্ধ করা যথেষ্ট নয়। নদী থেকে বৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং এর উপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। সরকারের উচিত একটি সুনির্দিষ্ট মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা, যা নদীর গভীরতা, পানির প্রবাহ এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে নদী থেকে টেকসইভাবে সম্পদ আহরণ সম্ভব হবে এবং তা স্থানীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।
এছাড়াও, অভিযানে যে সমস্ত ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান জরুরি। কেননা, এ ধরনের কঠোর শাস্তি ভবিষ্যতে অন্যদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন নদী রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখা যাবে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর জনগণের আস্থাও বাড়বে।
সর্বোপরি, আড়িয়াল খাঁ নদে পরিচালিত এ অভিযান একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলেছে। এ অভিযান কেবল একটি আইনশৃঙ্খলাজনিত কার্যক্রম নয়, এটি একটি সচেতনতামূলক বার্তাও বটে — যে নদী আমাদের জীবন, আমাদের অর্থনীতি এবং আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই নদীকে সুরক্ষিত রাখা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকেরও নৈতিক দায়িত্ব।
সামনে আরও এ ধরনের অভিযান চালিয়ে যেতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে নদী সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে দেশের নদীগুলোকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা যাবে, নদীপাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে, এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি সুস্থ, সুন্দর নদীময় বাংলাদেশ পাবে।
0 Comments