বেপরোয়া গতি কেড়ে নিলো ১১টি তাজা প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনা যেন বাংলাদেশের জনপদে একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষাদময় অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ঈদ, উৎসব বা বিশেষ কোনো ছুটির মৌসুমে সড়কগুলোতে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে অসতর্কতা, বেপরোয়া গতি, আইন না মানা এবং অনিয়ন্ত্রিত চালকের দায়িত্বহীনতা। এর সঙ্গে সড়কের বেহাল দশা এবং ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা যুক্ত হয়ে যেন একটি মৃত্যু ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে আমাদের দেশের মহাসড়কগুলোতে। সম্প্রতি ময়মনসিংহের তারাকান্দা ও ফুলপুর উপজেলায় ঘটে যাওয়া দুটি পৃথক সড়ক দুর্ঘটনা তারই একটি মর্মান্তিক উদাহরণ, যেখানে মাত্র এক দিনের মধ্যে ১১ জনের প্রাণ অকালে চলে গেছে এবং আহত হয়েছে অন্তত ৫ জন।
ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, বিকেল এবং সন্ধ্যা নাগাদ। প্রত্যক্ষদর্শী এবং পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, একটি দুর্ঘটনা ঘটে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় এবং আরেকটি ঘটে ফুলপুর উপজেলায়। প্রথম দুর্ঘটনায় একটি যাত্রীবাহী বাস এবং একটি পণ্যবাহী ট্রাকের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। বাসটিতে বেশ কয়েকজন যাত্রী ছিলেন, যারা ঈদের ছুটি শেষে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরছিলেন। ট্রাকটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বাসটির সঙ্গে তার ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে এবং সঙ্গে সঙ্গে বাসটি খাদে ছিটকে যায়। এ দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ছয়জন নিহত হন এবং গুরুতর আহত হন অনেকে। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অপর দুর্ঘটনাটি ঘটে ফুলপুর উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে, যেখানে একটি প্রাইভেটকার এবং একটি পিকআপভ্যানের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রাইভেটকারটির চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং বিপরীত দিক থেকে আসা পিকআপভ্যানটিকে এড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে দুই গাড়ির মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ঘটে এবং ঘটনাস্থলেই পাঁচজন নিহত হন। দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় জনগণ উদ্ধারকাজ শুরু করেন এবং পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
সড়ক দুর্ঘটনার এমন মর্মান্তিক চিত্র শুধু নিহতদের পরিবারের নয়, গোটা দেশের জন্য একটি বড় সংকট। আমরা অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন কার্যকর করা, চালকদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধির মতো নানা পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে বাস্তবে দেখা যায়, কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় না। যাত্রীপরিবহন খাতে অরাজকতা, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, দক্ষহীন চালক, চালকের অনিয়মিত লাইসেন্স এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা একসঙ্গে মিলে প্রতিদিন আমাদের অসংখ্য প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হল মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের অভাব। অনেক চালকই ভেবেচিন্তে না করে নিজেদের এবং যাত্রীদের জীবনকে বিপদে ফেলেন। অনেক সময় দেখা যায়, চালকরা অপ্রাপ্তবয়স্ক, অদক্ষ বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যান চালাচ্ছেন, যা একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে সড়কপথের বেহাল দশা, যেখানে খানাখন্দে ভরা রাস্তা, অপর্যাপ্ত সিগন্যাল ব্যবস্থা এবং ট্রাফিক পুলিশের অনিয়মিত উপস্থিতি দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ—সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। সবচেয়ে আগে দরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। যাত্রীপরিবহনে নিযুক্ত প্রতিটি চালকের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা এবং অনিয়মিত, লাইসেন্সবিহীন চালককে পরিবহন খাতে কাজ করতে না দেওয়া। এর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং যে সব যানবাহন সড়কে চলাচলের অযোগ্য, সেগুলোকে জরিমানা করে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। সড়কগুলোকে নিরাপদ এবং ট্রাফিক সিগন্যালগুলোকে কার্যকর করার মাধ্যমে আমরা অনেকটাই দুর্ঘটনার হার কমাতে পারি।
এছাড়াও গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, গণপরিবহন টার্মিনাল এবং বিভিন্ন মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে। চালকদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে যে সড়কে তাদের দায়িত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যাত্রীরাও যেন কোনোভাবে চালককে অতিরিক্ত গতি তুলতে না বলেন এবং সিটবেল্ট বেঁধে, ট্রাফিক আইন মেনে যাতায়াত করেন।
পরিবারগুলো হারাচ্ছে তাদের প্রিয়জনকে, অসহায় হয়ে পড়ছে শিশুরা, বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা চোখের জল ফেলছেন সন্তানের শোকে—এমন পরিস্থিতি আমাদের জন্য আর মেনে নেওয়ার মতো নয়। প্রতিদিন এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু যেন আমাদের দেশের একটি অনিবার্য অংশ না হয়ে ওঠে। একসঙ্গে কাজ করে, দায়িত্বশীল হয়ে, কঠোর আইন প্রয়োগ করে এবং সচেতনতা তৈরি করে আমরা চাইলে দুর্ঘটনার হার অনেকটাই কমাতে পারি।
সর্বোপরি, সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি সাধারণ দুর্ঘটনা নয়; এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক বিপর্যয়। প্রত্যেকটি প্রাণ একটি পরিবারের স্বপ্ন, আশা এবং ভালোবাসায় ভরা একটি গল্প বহন করে। সেই গল্পগুলো এভাবে হঠাৎ করে থেমে যাওয়া যেন আমাদের সমাজের একটি বড় ব্যর্থতা। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি যাত্রা যেন নিরাপদে শেষ হয়, সেজন্য প্রয়োজন আমাদের সবার একতা, সচেতনতা এবং আন্তরিকতা। ময়মনসিংহের তারাকান্দা ও ফুলপুর উপজেলায় ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। আশা করি, আমরা এর মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করব এবং ভবিষ্যতে আর যেন এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
0 Comments