আদালত অবমাননা মামলা: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শুনানি আজ
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার একটি মামলার চূড়ান্ত শুনানি আজ, ১৯ জুন ২০২৫, অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (ICT-1)। মামলাটি শুরু থেকেই দেশব্যাপী তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক শালীনতা এবং বক্তব্যের দায়বদ্ধতা নিয়ে এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে।
মামলার সূচনা ও প্রেক্ষাপট
মামলাটি দায়ের হয় ৩০ এপ্রিল ২০২৫, যখন একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি অডিও বার্তাতে শেখ হাসিনা এবং ছাত্রলীগের গাইবান্ধা জেলা শাখার সাবেক নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলের কথোপকথনের একটি অংশ প্রকাশ্যে আসে। ওই অডিওতে শেখ হাসিনা কথিতভাবে বলেছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা হয়েছে, তাই ২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়েছি।” এই বক্তব্যটিকে আদালতের প্রতি অবমাননাকর ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী হিসেবে চিহ্নিত করে আদালত অবমাননার মামলা রুজু করা হয়।
এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ ইস্যু করা হয় এবং তার ও শাকিল আকন্দের আদালতে হাজিরার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল ২৫ মে এবং ২৬ মে দুইটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়ে দেয় যে, ৩ জুন ২০২৫–এর মধ্যে আসামিদের হাজিরা দিতে হবে, অন্যথায় একতরফা শুনানি শুরু হবে। কিন্তু নির্ধারিত তারিখেও তারা আদালতে হাজির না হওয়ায়, ১৯ জুন ২০২৫ চূড়ান্ত শুনানির দিন ধার্য করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম
এই মামলার বিচার কার্যক্রম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। তার সঙ্গে বিচারক হিসেবে রয়েছেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালটি দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার করে আসছে, তবে এই মামলাটি একটু ব্যতিক্রম। এটি সরাসরি কোনো যুদ্ধাপরাধ নয়, বরং আদালত অবমাননার আওতায় একটি রাজনৈতিক উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির বক্তব্যের প্রশ্নে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রসিকিউশনের অবস্থান
প্রসিকিউশন দাবি করেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এমন একটি সময় আদালত নিয়ে বিতর্কিত ও অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন, যখন দেশে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুসংহত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা ধরে রাখার জন্য এমন বক্তব্যকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করা দরকার বলেও তারা মত দিয়েছে।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক হিসেবে শেখ হাসিনার কাছ থেকে এমন বক্তব্য অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক। এটি কেবল আদালতের প্রতি অবমাননা নয়, বরং আইনের শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও বিবেচিত। প্রসিকিউশন আরও উল্লেখ করেছে যে, এ ধরণের মন্তব্য যদি বিনা জবাবে পার পেয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে কেউই আদালতের মর্যাদা রক্ষা করতে বাধ্য বোধ করবে না।
আসামিপক্ষের অনুপস্থিতি ও আইনি দিক
আসামিদের অনুপস্থিতি আদালত অবমাননা মামলাগুলোর জন্য গুরুতর বিবেচনা করা হয়। আদালত ইতোমধ্যে দুইবার জাতীয় দৈনিকে নোটিশ প্রকাশ করেছে, যা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ার অংশ। এতে বলা হয়েছিল, নির্ধারিত সময়ে তারা হাজির না হলে, আদালত একতরফাভাবে শুনানি চালাতে পারবে এবং রায় ঘোষণাও করতে পারবে। এটি আদালতের সংবিধান ও বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আদালত অবমাননা মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে আদালত সর্বোচ্চ এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫,০০০ টাকা জরিমানা দিতে পারে। একই সঙ্গে যদি আদালত মনে করে বিষয়টি আরও বড় পরিসরে বিচারযোগ্য, তবে উচ্চ আদালতে মামলাটি স্থানান্তর করারও ক্ষমতা রাখে।
রাজনীতি ও জনমত
এই মামলাটি রাজনৈতিকভাবে যেমন স্পর্শকাতর, তেমনি জনমতেও বিভক্তি তৈরি করেছে। শেখ হাসিনার দলীয় নেতাকর্মীরা এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছেন। তাদের দাবি, দেশে একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলা করে তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে, সাধারণ নাগরিক ও আইনজীবী মহলের একাংশ বলছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বক্তব্য সবসময় দায়িত্বশীল হতে হবে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি আদালত সম্পর্কে বিতর্কিত ও অসম্মানজনক মন্তব্য করেন, তাহলে সেটা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং পুরো জাতির বিচারিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
শুনানির গুরুত্ব ও সম্ভাব্য রায়
আজকের শুনানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একদিকে যেমন আদালতের কর্তৃত্ব বজায় রাখার বিষয়, তেমনি রাজনৈতিক উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্তও তৈরি করবে। আদালতের রায় যদি আসামিদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে এটি বিচার বিভাগের একটি শক্তিশালী বার্তা হিসেবে কাজ করবে — আইন সবার জন্য সমান, এমনকি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও এর বাইরে নন।
অপরদিকে, যদি আদালত আসামিদের বক্তব্যকে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ হিসেবে বিবেচনা করে মামলা খারিজ করে দেন, তবে তা অন্য এক বার্তা দেবে — যে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে নয়, বরং আইনের যথাযথ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
ভবিষ্যত প্রভাব
এই মামলার রায় যাই হোক, এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। যদি শেখ হাসিনা দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। যদিও তিনি আপিল করতে পারবেন, কিন্তু এই মামলা ইতোমধ্যে তাঁর ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া, এই মামলা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম ও রাজনীতির একটি আন্তঃসম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরেছে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আদালতের মর্যাদা, এবং রাজনীতির দায়বদ্ধতা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
উপসংহার
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলার আজকের শুনানি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য একটি পরীক্ষার মঞ্চ। এটি কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি বার্তা — আদালতের সম্মান সকল নাগরিক, রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধির কাছে সমানভাবে মূল্যবান। আদালত অবমাননা মামলায় যেভাবেই রায় হোক না কেন, এই মামলা ইতিহাসে স্থান করে নেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সাক্ষ্য হিসেবে, যেখানে আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক আচরণ একই মঞ্চে সমান্তরালে অবস্থান করেছে।
0 Comments