শাড়ি পরে ভাইরাল ছবিগুলো কি অভিনেত্রী মিথিলার? জানুন সত্যতা
বর্তমান ডিজিটাল যুগে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ছবি বা ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক সময় সত্য ও মিথ্যার সীমানা অস্পষ্ট হয়ে যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, মানব উন্নয়নকর্মী, গায়িকা ও মডেল রাফিয়াথ রশিদ মিথিলাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় যা নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এই ছবিগুলোতে মিথিলা শাড়ি পরে হালকা ব্রাউন রঙের শাড়ি ও সাদা ব্লাউজে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সেলফি তুলছেন বলে দেখানো হয়। ছবিগুলোতে তার চেহারার অভিব্যক্তি ও স্টাইল অনেকেই প্রশংসা করেন এবং অনেকেই ছবিগুলো মিথিলার নতুন ফটোশুট বা ব্যক্তিগত মুহূর্ত হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে এই ভাইরাল ছবিগুলোর আসল সত্যতা অনেকেরই অজানা থেকে যায়।
মিথ্যার সত্যতা: ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তির ছায়া
যখন এসব ছবির পেছনের সত্য খুঁজে দেখা হয়, তখন জানা যায় এগুলো আসলে রাফিয়াথ রশিদ মিথিলার নয়, বরং প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি কৃত্রিম ছবি, যাকে বলা হয় ‘ডিপফেক’ ছবি। ডিপফেক হলো এমন এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি যার মাধ্যমে একটি ছবির বা ভিডিওর মুখের অংশ অন্য কারো মুখ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ, এটি একটি ভার্চুয়াল ম্যানিপুলেশন প্রযুক্তি যা যেকোনো ব্যক্তির মুখ বিভিন্ন ছবি বা ভিডিওতে বসানো যায়।
রিউমর স্ক্যানার নামের একটি স্বাধীন অনুসন্ধানকারী দল এই ভাইরাল ছবিগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ চালিয়ে নিশ্চিত করেছে যে, ভাইরাল ছবিগুলোতে আসলে ভারতের এক অভিনেত্রীর ছবির উপর মিথিলার মুখ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ, এটি সম্পূর্ণ একটি ভুয়া এবং মনগড়া ছবি, যা কৃত্রিম প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এবং প্রচার করা হচ্ছে। এই ধরনের ‘ডিপফেক’ ছবির উদ্দেশ্য অনেক সময় হয় কারো সুনামহানী, বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা সামাজিক প্রভাব বিস্তারের জন্য।
মিথিলার প্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা
রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা নিজেও এ ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়ায় সতর্কতা জারি করেছেন। তিনি ভক্ত ও সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ছবি দেখে বিভ্রান্ত না হন এবং শুধুমাত্র যাচাই-বাছাই করা তথ্য গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির অপব্যবহার দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এটি সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং সামাজিক মাধ্যমে ফেক ছবি বা ভিডিও শেয়ার করার ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে।
‘ডিপফেক’ প্রযুক্তির সুবিধা ও সমস্যা
‘ডিপফেক’ প্রযুক্তি মূলত ভিডিও প্রোডাকশন, সিনেমা ও বিনোদন জগতে বিশেষ প্রয়োগের জন্য তৈরি হলেও বর্তমানে এর অপব্যবহার ব্যাপক। উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এই প্রযুক্তি দিয়ে যে কারো মুখ অন্য ছবিতে বসানো বা ভিডিওতে বদলানো সম্ভব। ফলে পরিচিত ব্যক্তিদের নামে মিথ্যা ছবি বা ভিডিও তৈরি করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণে অপপ্রচার চালানো হয়ে থাকে।
এর সুবিধা হিসেবে বলা যায়, এটি সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। তবে এর অপব্যবহার অনেক বেশি বিপজ্জনক, কারণ এর মাধ্যমে মানহানি, সাইবার বুলিং, প্রতারণা, হুমকি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এটি সামাজিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট করতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে ‘ডিপফেক’ ছবির ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব
বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও ইউটিউবে এই ধরনের ‘ডিপফেক’ ছবি ও ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ প্রায়ই এসব ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন, কারণ দেখতে খুবই বাস্তবসম্মত হয়। এতে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের জীবন ও সুনাম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি, মানহানিকর অভিযোগ ও বিতর্ক তৈরি হয়, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশেও ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তির অপব্যবহার বেড়ে চলেছে, যা সামাজিক নিরাপত্তা ও আইনি ব্যবস্থাপনায় বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এজন্য আইন প্রণেতারা এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ ও অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার ক্রাইম ইউনিটের গঠন এবং সচেতনতা মূলক ক্যাম্পেইন চালানো।
মিথিলার প্রতিভা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ
রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা বাংলাদেশের একজন বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী। তিনি একজন সফল অভিনেত্রী, গায়িকা, লেখক ও উন্নয়নকর্মী হিসেবে দেশ-বিদেশে সুপরিচিত। তার অভিনয় দক্ষতা ও সামাজিক সচেতনতামূলক কাজের জন্য তিনি প্রশংসিত। মিথিলা বহু নাটক, সিনেমা ও গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। তার সামাজিক কাজগুলো বিশেষ করে শিশু ও নারী উন্নয়ন ক্ষেত্রে প্রশংসিত।
তাই তাকে নিয়ে এ ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ছবি ছড়িয়ে পড়া তার প্রতি অন্যায় এবং তার সুনামের অবমূল্যায়ন। এটি তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
সচেতনতা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের জীবনকে অনেক সহজতর করেছে, তবে একই সঙ্গে তৈরি করেছে নতুন ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে ‘ডিপফেক’ ছবি ও ভিডিও একটি বড় সমস্যা। আমাদের উচিত প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতন হওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য যাচাই করা এবং কৃত্রিম ছবি বা ভিডিওকে ফাঁকি না খেতে শেখা।
সরকার, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে কৃত্রিম তথ্যের অপব্যবহার রোধ করা যায়। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক প্রচারণায় এসব বিষয়ের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা কঠোর করা ও প্রযুক্তিগত সমাধান গ্রহণ করা উচিত।
উপসংহার
সুতরাং, শাড়ি পড়ে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো যেখানে রাফিয়াথ রশিদ মিথিলার মতো দেখানো হয়েছে, তা আসলে ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা ভুয়া ছবি। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ছবির শিকার হওয়া থেকে বিরত থাকা এবং যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্য বিশ্বাস না করার জন্য সকলকে সচেতন হতে হবে। রাফিয়াথ রশিদ মিথিলার মত প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নামে এ ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, যাতে তাদের সুনাম ও সম্মান রক্ষা পায়।
0 Comments