অস্থির বিশ্ব অর্থনীতি ও স্বর্ণের পুনরুত্থান: এক অস্বস্তিকর সমীকরণে বিশ্ব বাজার
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির চিত্রপট এক অস্বস্তিকর সমীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, মার্কিন ডলারের দামের অনিয়মিত ওঠানামা, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি সংক্রান্ত নাটকীয়তা—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আবারও ফিরে এসেছে সেই চিরচেনা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে—স্বর্ণ।
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান চিত্র
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির গতি অনেকটাই মন্থর। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত অর্থনীতিগুলো ইতিমধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি। ২০২৪-২৫ সালের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া গতিতে বাড়তে থাকে। একইভাবে ইউরোপের জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
এর ফলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়ানোর পথে হাঁটছে, যা আবার বিনিয়োগ ও শিল্পখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও ভয়াবহ। কারণ, তাদের অর্থনীতি বৈদেশিক ঋণ ও আমদানি নির্ভর।
ডলারের দামের ওঠানামা
ডলারের দাম এখন অস্থিরতার আরেক নাম। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতিমালা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈদেশিক সম্পর্ক—সবই ডলারের মূল্যকে প্রভাবিত করছে। ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ডলারের দাম সাময়িকভাবে বাড়িয়ে দিলেও, বাজারে তেমন স্থিতিশীলতা আনতে পারছে না।
এই অনিশ্চয়তা বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্ব্যর্থতা তৈরি করছে। যেমন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার মান পড়ে যাচ্ছে, রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং বৈদেশিক রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে শুরু হওয়া "ট্রেড ওয়ার" বা বাণিজ্য যুদ্ধ এখনো বিশ্বের বাণিজ্যিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে। চীন, রাশিয়া, ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ, চীন-তাইওয়ান ইস্যু, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত—সব মিলিয়ে বাজারে অনিশ্চয়তার ছায়া আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এবং নিরাপদ সম্পদের খোঁজে ফিরছেন স্বর্ণের দিকে।
মূল্যস্ফীতির বিপরীতে স্বর্ণের অবস্থান
স্বর্ণ বরাবরই ‘হেজ এগেইনস্ট ইনফ্লেশন’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, যখন মুদ্রার মূল্য হ্রাস পায় বা বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, তখন স্বর্ণ তার প্রকৃত মূল্য ধরে রাখে বা বাড়ায়। বিশ্বজুড়ে যখন মুদ্রার মান কমে, তখন স্বর্ণের দাম বাড়ে।
বর্তমানে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দেশ তাদের মুদ্রা ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সময়ে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও স্বর্ণ মজুদ বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২3-২৪ অর্থবছরে চীন, রাশিয়া, ভারত, তুরস্কসহ অনেক দেশ তাদের স্বর্ণ রিজার্ভ বাড়িয়েছে।
স্বর্ণ কেন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে?
বর্তমানে যেসব কারণে স্বর্ণ আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছে তা হলো:
মুদ্রার অবমূল্যায়ন: অনেক দেশের মুদ্রার মান কমে যাচ্ছে, ফলে স্বর্ণকে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা: অর্থনৈতিক মন্দা এবং যুদ্ধাবস্থা মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষার চিন্তা করতে বাধ্য করছে।
চাহিদা বৃদ্ধি: বিয়েশাদি, উৎসব, এবং শিল্প খাতে স্বর্ণের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান।
আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিশ্বাসের ঘাটতি: ডলার নির্ভরতা কমিয়ে আনার চেষ্টায় অনেক দেশ স্বর্ণকে রিজার্ভ হিসেবে গ্রহণ করছে।
ভার্চুয়াল মুদ্রার বিকল্প: ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারে ধসের পর অনেকেই স্বর্ণে ফিরে আসছে।
বিনিয়োগকারীদের করণীয়
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বর্ণ একটি কার্যকর ‘সেফ হ্যাভেন’ হিসেবে বিবেচিত। তবে, অস্থায়ী লাভের আশায় হঠাৎ করে সব সম্পদ স্বর্ণে রূপান্তর না করে, দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু অংশ স্বর্ণে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বিশেষ করে যারা শেয়ারবাজার, রিয়েল এস্টেট বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে স্বর্ণ একটি অন্যতম নিরাপদ বিকল্প হতে পারে।
ডিজিটাল স্বর্ণের উত্থান
বর্তমানে শুধু ফিজিক্যাল গোল্ড নয়, বরং ডিজিটাল গোল্ড, গোল্ড ইটিএফ (ETF), এবং গোল্ড বন্ড এর চাহিদাও বাড়ছে। এতে করে মানুষ ঘরে স্বর্ণ না রেখেও, অনলাইন বা ব্যাংকিং মাধ্যমে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে পারছে। এটি নিরাপদ, সহজ এবং আধুনিক পদ্ধতির আওতায় পড়ছে।
ভবিষ্যৎ চিত্র ও বিশ্লেষণ
বিশ্বব্যাপী যেভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে স্বর্ণে ঝুঁকছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে স্বর্ণের অবস্থান ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। পরবর্তী পাঁচ বছরে যদি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে, তাহলে স্বর্ণের দাম আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ২৫০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে।
উপসংহার
বিশ্ব অর্থনীতি এখন যে অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছে, তাতে স্বর্ণ হয়ে উঠেছে নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অতীতে যেমন—যুদ্ধ, মহামারী বা অর্থনৈতিক মন্দার সময় মানুষ স্বর্ণে ভরসা রেখেছিল, তেমনই আজও মানুষ এই নিরাপদ সম্পদের দিকেই ঝুঁকছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী সেইজন, যিনি মুনাফার চেয়ে নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেন।
এজন্যই বলা যায়, স্বর্ণ এখন শুধু অলঙ্কার নয়, বরং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতীক।
0 Comments