হজ একটি মহাসংঘটিত ইবাদত, যা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। এর ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং এর সূচনা ইসলামের প্রিয় পয়গম্বরদের একজন, হযরত ইবরাহিম (আ.) এর সময় থেকেই। বর্তমান ইসলামী হজের অনেক রীতিনীতি, কাবা শরিফের তাৎপর্য এবং হজের মূল উপাদানসমূহ সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল।
এই প্রবন্ধে আমরা জানব হযরত ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)–এর যুগে হজ কেমন ছিল, তার গুরুত্ব, বিবরণ, এবং কিভাবে তার মাধ্যমেই হজের রীতি ইসলামে স্থাপিত হলো।
হযরত ইবরাহিম (আ.) – এর পরিচয়
হযরত ইবরাহিম (আ.) ছিলেন একজন মহান নবী এবং রাসূল, যিনি ছিলেন তাওহিদের দৃষ্টান্ত। তিনি একমাত্র আল্লাহর উপাসনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর পিতা আজার ছিলেন মূর্তি নির্মাতা এবং মুশরিক হলেও, ইবরাহিম (আ.) ছোটবেলা থেকেই মূর্তিপূজার বিরোধিতা করতেন।
কাবা শরিফ নির্মাণ এবং হজের সূচনা
হজের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো কাবা শরিফ, যা আল্লাহর ঘর হিসেবে পরিচিত। এই ঘরটি নির্মাণ করেন হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)।
কুরআনের ভাষ্য:
“আর স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাইল এই ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল এবং বলছিল, ‘হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে এটি গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’”
— (সূরা আল-বাকারা: ১২৭)
এই নির্মাণের পরই আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে নির্দেশ দেন:
“আর মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার ক্ষীণ উষ্ট্র চড়ে, যারা প্রত্যন্ত পথ থেকে আসে।”
— (সূরা হজ্জ: ২৭)
এই আয়াতে বর্ণিত ঘোষণাই হলো হজের সূচনা। হযরত ইবরাহিম (আ.) পাহাড়ে উঠে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। আল্লাহর হুকুমে মানুষের আত্মা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল, যার প্রতিফলন দেখা যায় আজও কোটি মানুষের হজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
হজের কার্যক্রম ইবরাহিম (আ.)-এর যুগে কেমন ছিল?
১. কাবা তাওয়াফ:
হজের সময় হাজীরা যে সাতবার কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করে তা “তাওয়াফ” নামে পরিচিত। ইবরাহিম (আ.)-এর সময় থেকেই কাবার চারপাশে প্রদক্ষিণের এই রীতির শুরু হয়। এটি আল্লাহর ঘরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আত্মসমর্পণের প্রতীক।
২. সাফা-মারওয়া সাঈ:
হযরত ইসমাইল (আ.)-এর মা হাজেরা (আ.) যখন পানি খুঁজতে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার ছোটাছুটি করেছিলেন, তখন তার এই কর্মকে স্মরণীয় করে তোলা হয়। আজকের হজে হাজীরা এই দুই পাহাড়ের মাঝে সাঈ করে সেই ঘটনার স্মরণ করেন।
কুরআনে বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।”
— (সূরা বাকারা: ১৫৮)
৩. জমজম কূপ:
ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে মরুভূমিতে রেখে গেলে, সেখানে জমজম কূপের সৃষ্টি হয় ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের আঘাতে। এই কূপের পানি আজও হজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. কুরবানি (যবেহ):
ইবরাহিম (আ.)-এর কুরবানি দেওয়ার প্রস্তুতির স্মৃতিতেই কুরবানির রীতি শুরু হয়। ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর হুকুমে কোরবানি দিতে চাইলেও আল্লাহ তাঁদের আনুগত্য দেখে একটি দুম্বা দিয়ে পরীক্ষা নেন। সেই থেকেই হজে কোরবানি করা হয়।
কুরআনে বলা হয়েছে:
“তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্নে সত্যতা প্রমাণ করলে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি।”
— (সূরা সাফফাত: ১০৫-১০৭)
৫. শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ (রামি):
যখন ইবরাহিম (আ.) শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাঁচতে তিন জায়গায় তাকে পাথর নিক্ষেপ করেন, তখন থেকেই এই রীতির শুরু। এখনো হাজীরা মিনার তিনটি জায়গায় (জামারাত) পাথর ছুঁড়ে এই ঘটনার স্মরণ করেন।
ইবরাহিম (আ.) ও তাওহিদের শিক্ষা
হজ শুধুমাত্র শারীরিক কিছু কার্যক্রম নয়, বরং তা একটি তাওহিদের মহা ঘোষণা। ইবরাহিম (আ.) সারা জীবন মূর্তিপূজার বিরোধিতা করেছেন এবং একমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন। হজের সব রীতিই ইবরাহিম (আ.)-এর তাওহিদ ভিত্তিক জীবনধারার প্রতিফলন।
বর্তমান হজ এবং ইবরাহিম (আ.)-এর যুগের হজের মিল
বর্তমানে যে হজ মুসলিমরা পালন করে, তার মূল ভিত্তিগুলো — তাওয়াফ, সাঈ, কুরবানি, রামি, ইহরাম — সবই ইবরাহিম (আ.)-এর সময় থেকেই চলে আসছে। শুধু পার্থক্য হলো— এখন মুসলমানরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে হজ পালন করেন, যেটি ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ।
উপসংহার
হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর যুগে হজ ছিল এক নিখাদ তাওহিদভিত্তিক ইবাদত, যা ছিল আত্মত্যাগ, আনুগত্য এবং আল্লাহর পথে নিরবিচারে আত্মসমর্পণের প্রতীক। আজও মুসলিমরা হজের মাধ্যমে সেই অনন্য ইতিহাসকে স্মরণ করে, সেই পথেই চলে যার সূচনা হয়েছিল কাবা নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
হজ যেন শুধু একটি রীতি নয়, বরং ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার বাস্তব প্রতিফলন। সেই আত্মত্যাগের গল্পে আছে শিক্ষা, দীক্ষা এবং চিরন্তন তাওহিদের আহ্বান।
0 Comments