Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

সাভারে বাবাকে কুপিয়ে হত্যা: আদরের মেয়ের হাতে নির্মম পরিণতি, উঠে এলো ঘৃণ্য এক পরিকল্পনার ভয়াবহতা


 সাভার, ঢাকা — রাজধানীর অদূরে সাভারের একটি আবাসিক এলাকায় ঘটেছে এক মর্মান্তিক এবং বিবেক নাড়া দেওয়া ঘটনা। এক পিতা, যিনি তাঁর মেয়েকে আদর-স্নেহে বড় করেছেন, শেষ পর্যন্ত সেই মেয়ের হাতেই নির্মমভাবে খুন হলেন। পুলিশি তদন্ত এবং পারিবারিক সূত্রে উঠে এসেছে ঘটনার পেছনের এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা এবং পারিবারিক অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র।


বাবার ভালোবাসার সীমা

আব্দুস সাত্তার (৫৬), পেশায় অবসরপ্রাপ্ত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একমাত্র মেয়েকে নিয়েই তাঁর জীবন ছিল। অনেক স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ঘিরে—ভালো মানুষ হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই আশাতেই মেয়েকে ভর্তি করান কলেজে। নিজের সীমিত আয় থেকেও সবসময় মেয়েকে ভালো রাখার চেষ্টা করতেন।


 সাভারে ফ্ল্যাটে একসঙ্গে বসবাস

সাভারে একটি ভাড়া করা ফ্ল্যাটে আব্দুস সাত্তার তাঁর মেয়ের সঙ্গে বসবাস করতেন। এক সময় মেয়ে অনুরোধ করে বলে যে তার দুই বান্ধবীকে সাবলেট হিসেবে থাকতে দিতে হবে। আব্দুস সাত্তার প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মেয়ের ইচ্ছার কথা ভেবে রাজি হন। তিনি নিজেই ডাইনিং রুমে ঘুমাতেন, যাতে মেয়ের বান্ধবীরা রুমে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে।


 নেশা ও অনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত

কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আব্দুস সাত্তার লক্ষ্য করতে থাকেন মেয়ের এবং তার বান্ধবীদের আচরণে অস্বাভাবিকতা। গভীর রাতে শব্দ, কথাবার্তার ধরন এবং বাইরে যাওয়া-আসার প্যাটার্নে পরিবর্তন আসে। তিনি একসময় জানতে পারেন, মেয়ে এবং বান্ধবীরা নিয়মিত মাদক গ্রহণ করে, এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

এক রাতে হঠাৎ তিনি মেয়েকে ও বান্ধবীদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। বিষয়টি তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। এক পিতার জন্য এর চেয়ে হৃদয়বিদারক কিছু হতে পারে না। তিনি মেয়েকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন, অনৈতিকতা থেকে ফিরে আসার অনুরোধ করেন। মাদক ও সম্পর্ক দুই বিষয়েই আপত্তি জানান।





 আইনি পদক্ষেপ ও হতাশার যাত্রা

আব্দুস সাত্তার বাধ্য হয়ে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কারণ মেয়ের আচরণ ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠছিল। অতীতে মেয়ের দ্বারা তাঁর নামে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়েছিল। আদালতের ফরেনসিক পরীক্ষায় সেটা প্রমাণ না হওয়ায় তিনি ছাড়া পান। সেই সময়ই তিনি মেয়ের মানসিক অবস্থার ভয়াবহতা অনুভব করেছিলেন।

তিনি বিষয়টি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গেও আলোচনা করেন, কিন্তু কেউই কার্যকর সমাধান দিতে পারেননি।


 পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড

তদন্তে জানা যায়, মেয়ে তাঁর বাবাকে “বাধা” হিসেবে দেখতে শুরু করে। বাবার উপস্থিতি এবং বাধা তার জীবনধারা ও সম্পর্ক বজায় রাখতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে সে হত্যার পরিকল্পনা করে। ২০২৪ সালের ৯ মে ভোরে, মেয়েটি ঘুমন্ত অবস্থায় বাবার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

হত্যার পরপরই সে সাজায় একটি নাটক—জানি-না-কীভাবে ঘটনা ঘটলো, এমনকি বাবাকে ধর্ষণের চেষ্টার নাটক সাজিয়ে নিজের অবস্থানকে “নির্যাতিতার” জায়গায় স্থাপন করতে চায়। উদ্দেশ্য ছিল, যেন সে জনমতের সহানুভূতি পায় এবং সহজেই জামিনে মুক্তি পায়।


 পরিকল্পিত ভিডিও ও জনমতের অপব্যবহার

ঘটনার পর সে একটি ভিডিও রেকর্ড করে, যেখানে নিজের নির্দোষত্ব তুলে ধরে এবং জনগণের প্রতি আহ্বান জানায় যেন তারা তার মুক্তির পক্ষে দাঁড়ায়। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এতে দেখা যায় সে কান্নাকাটি করছে এবং অভিযোগ করছে বাবা তাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, তাই সে আত্মরক্ষার্থে খুন করেছে।

কিন্তু পুলিশি তদন্তে ও ফরেনসিক রিপোর্টে এসব তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তার আগের মামলা ও আচরণও তদন্তে সামনে আসে।

 তদন্তের অগ্রগতি

পুলিশ এখন পর্যন্ত মেয়েকে গ্রেফতার করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় মামলা রুজু করেছে। ঘটনার পেছনে অন্য দুই বান্ধবীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একটি পরিকল্পিত এবং ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড।


সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

এ ঘটনাটি কেবল একটি পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নয়; এটি সমাজের নৈতিক এবং পারিবারিক কাঠামোর একটি ভাঙনের প্রতিচ্ছবি। সন্তানদের স্বাধীনতা দিতে গিয়ে অনেক সময় অভিভাবকেরা সীমারেখা ভাঙেন না, কিন্তু সন্তান সেই বিশ্বাসের অপব্যবহার করে।

একটি পরিবারে বাবা-মেয়ে সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্কগুলোর একটি। সেটি যদি বিশ্বাস, মমতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে না গড়ে উঠে, তাহলে এর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে এ রকমই। এই ঘটনায় যেমন মেয়ের নৈতিক পতন ছিল, তেমনি একজন পিতার অসহায়তা ও নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা প্রতিফলিত হয়েছে।


 সাংবাদিকদের জন্য বার্তা:

এ ধরনের সংবেদনশীল ঘটনা কভার করার সময় ভিকটিম ও অভিযুক্তের পরিচয়, আচরণ, সম্পর্ক ইত্যাদি সাবধানে প্রকাশ করা উচিত। যেন সমাজে বিদ্বেষ ছড়ায় না বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী কলঙ্কিত না হয়। সমকামীতা কিংবা অন্য জীবনধারাকে অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করা আইনত ও নীতিগতভাবে সঠিক নয়। অপরাধ হচ্ছে হত্যা—সেটিকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখানো জরুরি।


 উপসংহার

আব্দুস সাত্তারের এই নির্মম পরিণতি আমাদের সবাইকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: আমরা কি আমাদের সন্তানদের যথাযথ মূল্যবোধ শেখাতে পারছি? স্বাধীনতা আর অনুশাসনের সীমা কোথায়? মাদক, বিকৃত সম্পর্ক এবং পারিবারিক বন্ধনের অভাব কি আমাদের সমাজকে এই জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে?

এ ঘটনার পূর্ণ তদন্ত ও ন্যায়বিচারই কেবল নয়—এই ধরণের পারিবারিক বিপর্যয় প্রতিরোধেও আমাদের সকলের দায়িত্ব রয়েছে।

Post a Comment

0 Comments