ভূমিকা
বাংলাদেশের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার শুধু পর্যটকদের ভ্রমণের কেন্দ্র নয়, এখন হয়ে উঠছে অ্যাডভেঞ্চার ও ওয়াটার স্পোর্টসের প্রাণকেন্দ্রও। সেই ধারাবাহিকতায় আয়োজন করা হলো জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতা ২০২৫, যা দেশের তরুণ-তরুণীদের মাঝে অ্যাকশন স্পোর্টসের প্রতি আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশনের (BSA) আয়োজনে এই প্রতিযোগিতায় দেশজুড়ে শতাধিক সার্ফার অংশগ্রহণ করেন। তরঙ্গের বুকে ভেসে যাওয়া, ব্যালান্স, সাহস ও কৌশলের দারুণ মিশেল ছিল প্রতিটি মুহূর্তে।
প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা
এবারের জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টে। ৩ দিনব্যাপী এ আয়োজনে সার্ফারদের মধ্যে ছিল বিপুল উৎসাহ ও প্রতিযোগিতা।
আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক:
বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশন (BSA)
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন
সহযোগিতায় ছিল বিভিন্ন বেসরকারি পর্যটন ও ক্রীড়া সংগঠন।
BSA-এর সভাপতি বলেন:
“বাংলাদেশের তরুণদের সাগরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং আন্তর্জাতিক সার্ফিং প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে এ জাতীয় আয়োজন অত্যন্ত জরুরি।”
অংশগ্রহণকারীদের উচ্ছ্বাস ও প্রস্তুতি
দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় জেলা যেমন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী এবং ঢাকার শখের সার্ফাররাও অংশগ্রহণ করেন এ প্রতিযোগিতায়।
প্রতিযোগীদের বয়সভিত্তিক ভাগ করা হয় তিনটি বিভাগে:
জুনিয়র (১৪-১৮ বছর)
ওপেন (১৯-৩৫ বছর)
মহিলা বিভাগ
কক্সবাজারের স্থানীয় যুবক রাশেদ বলেন:
“আমি ছোটবেলা থেকেই সমুদ্রের তরঙ্গে নেমে সার্ফিং করি। আজকে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিতে পেরে গর্বিত।”
প্রতিযোগিতার নিয়ম ও মূল্যায়ন
জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতাটি আন্তর্জাতিক সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশন (ISA)-এর নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়।
মূল্যায়নের মানদণ্ড ছিল:
তরঙ্গে ওঠার সময় ব্যালান্স
টার্নিং স্টাইল ও কার্ভ
সময় ধরে তরঙ্গ ধরে রাখার দক্ষতা
কৌশলগত মুভমেন্ট
প্রতিটি সার্ফার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩টি তরঙ্গে অংশ নিয়ে তাদের সেরা ২টি স্কোরের ভিত্তিতে চূড়ান্ত র্যাঙ্কিং পায়।
দর্শকদের উল্লাস
সৈকতে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শক ভিড় করে দেখেছেন তরুণদের এ মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী। তরঙ্গের গায়ে চড়তে দেখে অনেকেই প্রথমবারের মতো সার্ফিং দেখেছেন এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন।
স্থানীয় পর্যটক রুবিনা আক্তার বলেন:
“এতদিন ভাবতাম সার্ফিং কেবল বিদেশে হয়। আজ আমাদের কক্সবাজারে দেখে গর্ব লাগছে।”
বিজয়ীদের তালিকা
প্রতিযোগিতার শেষে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক, পর্যটন করপোরেশন ও BSA কর্মকর্তারা।
ওপেন বিভাগ:
প্রথম: ফয়সাল হোসেন (চট্টগ্রাম)
দ্বিতীয়: মাহি রহমান (কক্সবাজার)
তৃতীয়: নাইম আহমেদ (বরগুনা)
মহিলা বিভাগ:
প্রথম: আনিকা পারভিন (ঢাকা)
দ্বিতীয়: রুবাইয়া সুলতানা (কক্সবাজার)
তৃতীয়: তাসনুভা আফরিন (চট্টগ্রাম)
জুনিয়র বিভাগ:
প্রথম: সাব্বির রানা (পটুয়াখালী)
দ্বিতীয়: রাইসা মেহেদী (নোয়াখালী)
বিজয়ীদের দেওয়া হয় সার্টিফিকেট, ট্রফি ও আর্থিক পুরস্কার।
কক্সবাজারের সার্ফিং সংস্কৃতি: সম্ভাবনার দ্বার
বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল তার ঢেউ, জলরাশি ও আবহাওয়ার কারণে সার্ফিংয়ের জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে এখানকার তরুণদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক সার্ফিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব বলেন:
“আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সার্ফিং হাব হিসেবে গড়ে তোলা। কক্সবাজারে সার্ফিং স্কুল, ট্রেনিং সেন্টার ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।”
পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সার্ফিং প্রতিযোগিতায় নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় কাজ করেছে:
কক্সবাজার কোস্টগার্ড
লাইফগার্ড ইউনিট
ফায়ার সার্ভিস
প্লাস্টিকমুক্ত সৈকত ক্যাম্পেইনের আওতায় সৈকতের আশেপাশে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা হয় এবং সচেতনতা পোস্টার টানানো হয়।
স্থানীয় পর্যটনে ইতিবাচক প্রভাব
এই জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতা স্থানীয় পর্যটন খাতেও নতুন দিগন্ত খুলেছে।
হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকানগুলোতে বেড়েছে বাণিজ্য
দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন বেড়েছে
মিডিয়ার নজরে এসেছে কক্সবাজারের ‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ট্যুরিজম’
উপসংহার
জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতা শুধু একটি খেলাধুলার আয়োজন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন, তরুণ সমাজের মনোবিকাশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটি পদক্ষেপ।
যেখানে তরঙ্গের মাঝে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের সাহস, সামর্থ্য ও স্বপ্নকে একত্র করে তুলে ধরেছে, সেখান থেকেই বাংলাদেশে সার্ফিং খেলাধুলার নবযাত্রা শুরু হলো।
0 Comments