২০২৫ সালের ৩১ মে দিবাগত রাতে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের বখতিয়ারঘাট এলাকায় ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। টানা বর্ষণে টিলা ধসে পড়ে একটি বসতঘরের উপর, যেখানে ঘুমাচ্ছিল একই পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় প্রাণ হারান চারজন—রিয়াজ উদ্দিন, তার স্ত্রী রহিমা বেগম, মেয়ে সামিয়া খাতুন এবং ছেলে আব্বাস উদ্দিন। এ ঘটনাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় পাহাড় ও টিলা এলাকায় বসবাসরত মানুষের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
ঘটনার বিবরণ
ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন পরিবারটি, কিন্তু ঘুম ভাঙেনি আর কারো। রাত আনুমানিক ২টার দিকে প্রচণ্ড শব্দে পাশের টিলা ধসে পড়ে তাদের ঘরের উপর। পরিবারটির সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় মাটিচাপা পড়েন। স্থানীয়রা চিৎকার ও শব্দ শুনে ছুটে আসেন, কিন্তু তখনো ঘোর অন্ধকার, প্রবল বৃষ্টির মধ্যে উদ্ধার কাজ দুরূহ হয়ে পড়ে।
উদ্ধার কার্যক্রম
প্রথমে স্থানীয় বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। কিন্তু মাটি ও কাদার স্তর এতটা পুরু ছিল যে সাধারণ হাত দিয়ে কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনকে। ভোরে তারা এসে যৌথভাবে উদ্ধার কাজ শুরু করে এবং সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চারটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কয়েকদিন ধরেই প্রবল বর্ষণ চলছিল, এবং টিলা এলাকায় আগেই ছোটখাটো ধসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই ধসটি ছিল ভয়াবহ। আশেপাশের মানুষেরা এমন ঘটনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।
নিহতদের পরিচয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
নিহত রিয়াজ উদ্দিন একজন দিনমজুর ছিলেন। তার পরিবার ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। টিলা ঘেঁষে জায়গা নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, কারণ জমির মূল্য সস্তা ছিল। কিন্তু এই সস্তা জমিই তাদের প্রাণ কেড়ে নিল। পরিবারটির বাকি সদস্যরা কেউ বেঁচে নেই, ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রশাসনের পদক্ষেপ
ঘটনার পরপরই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিবারটির দাফনের জন্য নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় এবং এলাকার অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ টিলা ঘরগুলোতে বসবাসকারী পরিবারগুলোর তালিকা প্রণয়ন করে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বর্ষাকালে টিলা ও পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধে বারবার সতর্কতা জারি করা হয়। কিন্তু অনেকে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এই এলাকাগুলোতেই বসবাস করতে বাধ্য হন।
টিলা ধস: প্রাকৃতিক না মানবসৃষ্ট?
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে টিলা ও পাহাড়ি ভূমি রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে বিগত বছরগুলোতে টিলা ধসের ঘটনা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিলাগুলোতে অপরিকল্পিত বসতি, গাছপালা কাটার ফলে ভূমির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে মাটি দুর্বল হয়ে ধসে পড়ে।
এই ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট অবহেলা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ একত্রিত হয়ে প্রাণঘাতী বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। পরিবেশবিদদের মতে, সরকারি অনুমতি ছাড়া টিলা বা পাহাড়ি এলাকায় বসতঘর তৈরি বন্ধ করা দরকার, সেইসাথে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো জরুরি।
অতীতের দৃষ্টান্ত
এই প্রথম নয়, এর আগেও সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটিতে টিলা ও পাহাড় ধসে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ধসে ১৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর থেকে প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের প্রতি আহ্বান
সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে কম মূল্যের টিলা জমিতে বসবাস করেন, কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারেন না এর ভয়াবহ ঝুঁকি। বৃষ্টির মৌসুমে এদের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
প্রশাসনের উচিত প্রতি বর্ষা মৌসুমে আগেভাগে সম্ভাব্য ধসপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
সিলেটে টিলা ধসে একই পরিবারের চারজনের করুণ মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি বার্তা—আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সচেতনতায় ঘাটতির ফল। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করাই এই ধরনের প্রাণহানির সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা আমাদের হাতে না থাকলেও, সচেতন পরিকল্পনা ও সময়োচিত পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রত্যেক জীবনই মূল্যবান, এবং সেই মূল্য রক্ষা করতে আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে।
0 Comments