বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে পাট এক গৌরবময় নাম। এক সময় পাটই ছিল আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য, যার মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছিল। তবে শিল্পায়নের আধুনিক ধারা এবং পলিথিনের আগ্রাসনে পাট তার পূর্বের অবস্থান হারাতে শুরু করে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাটের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য এর ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
পাট: আবেগের নাম, ইতিহাসের অংশ
প্রফেসর ইউনূস বলেন:
“যখন আপনি পাট নিয়ে কথা বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি আবেগের বিষয়। এই দেশটি একটি অনন্য দেশ, যে দেশ বহু বছর ধরে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক তন্তু উৎপাদন করে আসছে।”
পাট আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের গ্রামবাংলার প্রতিটি কৃষকের ঘাম ঝরেছে এই তন্তু ফসলে। পাটের সঙ্গে যুক্ত ছিল লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান ও হাজার হাজার মিল-কলকারখানা। সুতরাং এর গৌরব হারিয়ে যাওয়া কেবল অর্থনৈতিক নয়, এক ধরনের জাতীয় ক্ষতি।
পাটের বর্তমান অবস্থা ও পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে দেশে কিছু সীমিত পরিসরে পাটচাষ হলেও, তা কৃষকের জন্য তেমন লাভজনক নয় বলে অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আবার পাটজাত পণ্যের ব্যবহার না থাকায় চাষ করা পাট বিক্রি করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন প্রয়োজন এবং বাজারজাতকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার।
ড. ইউনূস বলেন, “দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে হলে আমাদের নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভর করতে হবে। পাট হলো এমন এক প্রাকৃতিক সম্পদ, যা পরিবেশবান্ধব, নবায়নযোগ্য এবং বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী।"
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাটের সম্ভাবনা
আধুনিক বিশ্ব এখন পরিবেশবান্ধব পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, তার পেছনে পাট হতে পারে অন্যতম শক্তিশালী বিকল্প। প্রফেসর ইউনূস বলেন,
“বিশ্বের বাজারে এখন পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের পাটের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হতে পারে।”
পাট থেকে তৈরি হতে পারে ব্যাগ, কাপড়, চট, গাড়ির ভেতরের অংশ, জুতা, ছাতা, এমনকি আধুনিক বায়ো-কম্পোজিট সামগ্রী। ইতোমধ্যে ইউরোপ ও জাপান সহ অনেক দেশ পাটের তৈরি পণ্যের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
উদ্যোগ এবং সরকারি পদক্ষেপের গুরুত্ব
ড. ইউনূসের আহ্বানে বোঝা যায় যে, শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে নয়, বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে—সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকে। যেমন:
আধুনিক পাটকল স্থাপন ও প্রযুক্তি সংযোজন
কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পাটচাষে প্রণোদনা
পাটজাত পণ্যের বাজারজাতকরণে রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সম্প্রসারণ
তরুণ উদ্যোক্তাদের পাটভিত্তিক স্টার্টআপে উৎসাহ প্রদান
সমাজিক ব্যবসা ও পাটের নতুন বিপ্লব
ড. ইউনূস সবসময়ই সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা। তাঁর মতে, পাটকে ঘিরে সামাজিক ব্যবসার বিশাল ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। যেমন:
গ্রামীণ নারীদের দ্বারা হস্তনির্মিত পাটজাত পণ্য
শিশুদের জন্য পরিবেশবান্ধব খেলনা
মাটির সঙ্গে মিশে যায় এমন প্যাকেজিং উপকরণ
এ ধরনের উদ্যোগ শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে না, বরং দেশের রপ্তানি আয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
উপসংহার
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই আহ্বান কেবল একটি বক্তব্য নয়, বরং একটি জাতীয় কর্মসূচিতে রূপ নেওয়ার মত শক্তিশালী বার্তা। পাট নিয়ে নতুন করে ভাবা এবং এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করাই হতে পারে বাংলাদেশের আত্মনির্ভর অর্থনীতির এক নতুন সূচনা।
আসুন, পাটের গৌরব ফিরিয়ে আনতে আমরা সবাই একযোগে কাজ করি—পরিবেশ রক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের উন্নয়নের জন্য।
0 Comments