২০২৫ সালের মে মাসে ইসরায়েল-গাজা সংঘর্ষ আবারো এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, হামাসের পাল্টা প্রতিরোধ, এবং সাধারণ মানুষের সীমাহীন কষ্ট – সব মিলে একটি গভীর মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নির্দেশে সামরিক বাহিনী গাজার অভ্যন্তরে স্থল অভিযান শুরু করেছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
সংঘর্ষের পটভূমি
গাজা এবং ইসরায়েলের মধ্যকার এই সংঘর্ষ নতুন নয়। ২০০৬ সাল থেকে হামাস গাজায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে এর সম্পর্ক বৈরিতার দিকে গিয়েছে। বিগত বছরগুলোতে বহুবার ছোট-বড় সংঘর্ষ হলেও ২০২৫ সালের এই ঘটনাগুলো বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ, এতে অসংখ্য সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, এবং গাজার ভেতরে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের অভিযান
ইসরায়েল ২০২৫ সালের মে মাসে গাজার খান ইউনিস এলাকায় বড় আকারের সামরিক অভিযান চালায়। সামরিক সূত্রে জানা যায়, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল হামাসের সামরিক ঘাঁটি ও অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই অভিযানে বহু বেসামরিক স্থাপনা যেমন হাসপাতাল, স্কুল, ও আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা টার্গেট করা হামলা চালাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষকে এলাকা খালি করার জন্য পূর্ব সতর্কতা দিচ্ছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই সতর্কতা অপ্রতুল এবং বাস্তবে নিরীহ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মানবিক সংকট
এই সংঘর্ষের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হলো মানবিক সংকট। গাজা একপ্রকার অবরুদ্ধ অঞ্চল। ইসরায়েলের অবরোধ ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, মিশরের সীমিত সাহায্য, এবং বিমান হামলার ফলে গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ চরম খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, এবং চিকিৎসার অভাবে ভুগছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় প্রতিদিন প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধের ৩০ শতাংশেরও কম প্রবেশ করতে পারছে। বহু হাসপাতাল জেনারেটর দিয়ে চললেও, জ্বালানির অভাবে সেগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই সংঘর্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ ইসরায়েলকে মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন নেতানিয়াহুর উপর চাপ সৃষ্টি করেছে যাতে তিনি গাজায় দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেন।
এই চাপের ফলেই ইসরায়েল গত সপ্তাহে সীমিত আকারে মানবিক সহায়তা পুনরায় শুরু করেছে, তবে এটি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্ব থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও বিক্ষোভ চলছে।
হামাসের প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধনীতির পরিবর্তন
হামাস একাধিকবার ইসরায়েলের তেল আবিব, আশকেলন এবং আশদোদ শহরের দিকে রকেট হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় কিছু ইসরায়েলি নাগরিকও হতাহত হয়েছেন। যদিও ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিরভাগ রকেট আটকাতে সক্ষম হয়েছে, তবুও নিরাপত্তা নিয়ে জনগণের উদ্বেগ বাড়ছে।
হামাসও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে দমন-পীড়নের শিকার হিসেবে উপস্থাপন করছে এবং গাজার জনগণকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
সংঘর্ষের সবচেয়ে করুণ ছবি ফুটে উঠছে সাধারণ মানুষের জীবনে। গাজার মানুষজন যখন বোমার শব্দে ঘুম ভাঙছে, তখন তাদের মাথার উপর ছাদ নেই, আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেই, এবং খাবারের অভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে। বহু শিশু এতদিন স্কুলে যেত, এখন তারা কাঁধে ব্যাগ নয়, বরং পানি বহন করছে দূর-দূরান্ত থেকে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘর্ষ যদি দ্রুত বন্ধ না হয়, তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, এবং ইরানের মতো শক্তিগুলোর জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ প্রয়োজন।
উপসংহার
ইসরায়েল-গাজা সংঘর্ষ এখন আর কেবল একটি ভূরাজনৈতিক বিরোধ নয়; এটি একটি বিশাল মানবিক সংকট। একদিকে সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা, অন্যদিকে নিরীহ মানুষের চোখে অন্ধকার ভবিষ্যৎ—এই দুটি বাস্তবতা আমাদের বিশ্ব মানবতাবোধকে নাড়া দেয়। সমাধান একটাই: শান্তি, সংলাপ এবং সহানুভূতির ভিত্তিতে একটি টেকসই সমঝোতা।
0 Comments