ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ও দ্রুত বর্ধনশীল শহর। কিন্তু অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিবেশ দূষণের মাত্রাও। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বায়ু মান নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, কারণ এটি 'সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর' পর্যায়ে পৌঁছেছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI)-এ ঢাকার স্কোর ছিল ১৪৭, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশিকা অনুযায়ী উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মানদণ্ডে পড়ে।
এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হবে ঢাকার বায়ু দূষণের উৎস, এর মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর প্রভাব, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই সমাধানের পথ।
কী বোঝায় ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু?
বায়ু মান পরিমাপের আন্তর্জাতিক স্কেল হল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI)। এই সূচক অনুযায়ী:
0-50: ভাল
51-100: মডারেট
101-150: সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর (Unhealthy for Sensitive Groups)
151-200: অস্বাস্থ্যকর
201-300: অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর
301+: বিপজ্জনক
ঢাকার AQI যখন ১৪৭ ছুঁয়েছে, তখন এটি পরিষ্কারভাবে "সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর" বলে গণ্য হয়। এই গোষ্ঠীতে পড়ে শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী নারী এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। তাদের জন্য এমন বায়ু মান শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, অ্যাজমা, হৃদরোগসহ দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার ঝুঁকি বহন করে।
ঢাকার বায়ু দূষণের মূল কারণসমূহ
১. নির্মাণকাজ ও ধুলাবালি
ঢাকায় প্রতিনিয়ত চলছে নির্মাণকাজ—বাড়ি, সড়ক, মেট্রোরেল ও অন্যান্য অবকাঠামো। কিন্তু এ কাজগুলোতেও প্রায়শই পরিবেশবান্ধব নীতিমালা মানা হয় না। ফলে বিশাল পরিমাণ ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
যানবাহনের কালো ধোঁয়া
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া একটি প্রধান দূষণের উৎস। ডিজেলচালিত বাস, রিকশাভ্যান এবং অটোরিকশা দূষণ বৃদ্ধি করে।
ইটভাটা
ঢাকার আশেপাশে প্রায় ২,০০০-এর বেশি ইটভাটা আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই পরিবেশগত লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর ধোঁয়া এবং কণা বায়ুকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে।
শিল্পকারখানা ও রাসায়নিক নিঃসরণ
শিল্প এলাকা যেমন টঙ্গী, আশুলিয়া, সাভার থেকে নির্গত রাসায়নিক ও ধোঁয়া বায়ুতে ব্যাপক ক্ষতি করছে।
জ্বালানি পুড়িয়ে রান্না ও গৃহস্থালি কাজ
নিম্নবিত্ত মানুষেরা কাঠ, কয়লা, বা অন্যান্য জৈব জ্বালানি পুড়িয়ে রান্না করে, যা ইনডোর এবং আউটডোর উভয় বায়ু মান খারাপ করে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি
ঢাকার বায়ু দূষণ সরাসরি প্রভাব ফেলে মানুষের স্বাস্থ্যে। বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য এই দূষণ আরও বেশি বিপজ্জনক। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তুলে ধরা হলো:
শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা: ধুলিকণা ও সূক্ষ্ম পার্টিকুলেট (PM2.5) ফুসফুসে ঢুকে অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানা সমস্যা তৈরি করে।
হৃদরোগ: দূষিত বায়ু হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপের উপর প্রভাব ফেলে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকি: বায়ু দূষণ গর্ভে শিশুর বিকাশে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং জন্মগত জটিলতার সম্ভাবনা বাড়ায়।
চোখ ও ত্বকের সমস্যা: বায়ুর রাসায়নিক উপাদান চোখে জ্বালাপোড়া এবং ত্বকে অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিশুদের উপর প্রভাব
বিশেষ করে শিশুদের স্কুলে যাওয়া, খেলা করা ও বাইরের পরিবেশে স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ স্কুলে নেই কোনো নিরাপদ বায়ু ব্যবস্থা। দীর্ঘ সময় দূষিত বাতাসে থাকার ফলে শিশুদের ফুসফুসের পূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
পরিবেশের উপর প্রভাব
বায়ু দূষণ শুধু মানুষের স্বাস্থ্যের উপর নয়, পরিবেশের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে:
গাছপালার বৃদ্ধিতে বাধা
জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান
মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া
বৃষ্টির পানিতে অ্যাসিডিক উপাদান বৃদ্ধি
সরকারের উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন:
পরিবেশ অধিদপ্তরের আওতায় এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং।
অস্বাস্থ্যকর ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান।
পুরনো যানবাহন নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া।
তবে বাস্তবায়নের অভাব, দুর্নীতি, এবং আইন প্রয়োগে শিথিলতা এই উদ্যোগগুলোকে কাঙ্ক্ষিত সফলতা থেকে দূরে রাখছে।
সমাধান ও করণীয়
নির্মাণকাজে নিয়ম মেনে ধুলা নিয়ন্ত্রণ:
নির্মাণকাজে জল ছিটানো, ব্যারিকেড বসানো ও নেটিং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব যানবাহন প্রবর্তন:
ইলেকট্রিক বাস, সিএনজি এবং সাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে।
ইটভাটার উন্নয়ন:
জিগ-জ্যাগ বা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ইটভাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সবুজায়ন:
ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে বড় গাছের বাগান তৈরি ও পরিচর্যা করতে হবে।
সচেতনতামূলক প্রচার:
স্কুল, কলেজ, ও গণমাধ্যমে বায়ু দূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রতিকার সম্পর্কে প্রচার করতে হবে।
উপসংহার
ঢাকার বায়ু মান বর্তমানে যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 'সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর' স্তর ছাড়িয়ে যে কোনো সময় তা পুরো জনসাধারণের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিককে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।
পরিবেশ বাঁচলে—মানুষ বাঁচবে। বায়ু দূষণ রোধে আজই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো নির্মল বাতাস থেকেও বঞ্চিত হবে।
0 Comments