🇨🇦 কানাডার অঙ্গরাজ্য আলবার্টায় স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছে: ভাঙনের মুখে ফেডারেল একতা

 

ভূমিকা:
২০২৫ সালে এসে কানাডার একতা ও অখণ্ডতা নিয়ে আবারো প্রশ্ন উঠছে, এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ধনী অঙ্গরাজ্য আলবার্টা (Alberta)। প্রাদেশিক রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষের মতামত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সম্প্রতি একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, আলবার্টার বহু নাগরিক এখন কানাডা থেকে স্বাধীনতা চায় কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত হওয়ার চিন্তা করছে। প্রাদেশিক সরকারও ফেডারেল সরকারের নীতির বিরুদ্ধে আইনি ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি কেবল কানাডার অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং উত্তর আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

---

আলবার্টা: অর্থনীতির হৃদয়, কিন্তু অসন্তোষের কেন্দ্র

আলবার্টা কানাডার সবচেয়ে ধনী ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ প্রদেশগুলোর একটি। দেশটির তেল ও গ্যাস খাতের বড় একটি অংশ এখানেই অবস্থিত। তবে ইদানীং এই প্রদেশের অনেক বাসিন্দা মনে করছেন, ফেডারেল সরকার আলবার্টার সম্পদে ভাগ বসিয়ে প্রকৃত বিনিময় দিচ্ছে না।
অসন্তোষ বিশেষভাবে বেড়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ও পাইপলাইন নীতির কারণে, যা আলবার্টার তেল-গ্যাস অর্থনীতির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

---

ফেডারেল নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ

আলবার্টার প্রিমিয়ার ড্যানিয়েল স্মিথ সম্প্রতি একটি বিল উত্থাপন করেছেন—"Alberta Sovereignty Within a United Canada Act"—যার মাধ্যমে প্রদেশটি কিছু ফেডারেল আইন প্রয়োগে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে। এর অর্থ, কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আলবার্টা তাদের নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখতে চায়।
এমনকি প্রদেশটি কানাডার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে, যা অনেক বিশ্লেষকের মতে, de facto বিচ্ছিন্নতাবাদের পথে একধাপ অগ্রগতি।

---

সাম্প্রতিক জনমত জরিপ: বিভাজনের চিত্র

এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৪০% আলবার্টাবাসী মনে করেন—তাদের উচিত কানাডার অংশ না থাকা। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ স্বাধীন আলবার্টার পক্ষে, আবার কিছু বিশ্বাস করেন, আলবার্টা যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন অঙ্গরাজ্য হিসেবে যোগ দিলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে।

এই মানসিকতা অনেকাংশে ১৯৯৫ সালের কুইবেক গণভোটের ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়, যেখানে কুইবেক অল্প ব্যবধানে স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবে আলবার্টার প্রেক্ষাপট ভিন্ন—এটি জাতিগত বা ভাষাভিত্তিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আন্দোলন।

---

যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের ধারণা: বাস্তবতা না কল্পনা?

কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের দাবি তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তেলনির্ভর অঙ্গরাজ্য যেমন টেক্সাস ও ডাকোটা প্রভৃতি সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন তারা। অনেক আলবার্টাবাসীর মতে, সেখানে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিল থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সহজ হবে।

তবে বিশ্লেষকরা এটিকে এখনও বাস্তবসম্মত চিন্তা বলছেন না। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা—দুই দেশের মধ্যে সাংবিধানিক কাঠামো, নাগরিক অধিকার এবং বৈদেশিক নীতির দিক থেকে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তবু আলবার্টার অসন্তোষ এবং কানাডার ফেডারেল কাঠামোর প্রতি চ্যালেঞ্জ একটি বড় রাজনৈতিক সংকেত দিচ্ছে।

---

কানাডার ফেডারেল নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার পরিস্থিতিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। তিনি বলেছেন, "আলবার্টার প্রতি আমাদের সম্মান আছে, কিন্তু কানাডার সংবিধান ও সংহতি সর্বাগ্রে।"
তবে অনেকেই মনে করছেন, ট্রুডোর পরিবেশবান্ধব নীতি, পাইপলাইন স্থগিতকরণ ও ট্যাক্স নীতিই আলবার্টার জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে মধ্যপন্থী অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।

---

অর্থনৈতিক প্রভাব ও বাজার উদ্বেগ

আলবার্টা বিচ্ছিন্ন হলে কানাডার অর্থনীতিতে তা বিরাট প্রভাব ফেলবে। দেশের জিডিপির প্রায় ১৭% আসে এই প্রদেশ থেকে। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে পুরো উত্তর আমেরিকান জ্বালানি বাজারে তার প্রতিক্রিয়া পড়বে।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ইতোমধ্যেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে—আলবার্টা যদি রাজনৈতিকভাবে অস্থির থাকে, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বোধ করবেন না।

---

জাতীয় পরিচয়ের সংকট ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

আলবার্টার এই দাবি শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, এটি কানাডার জাতীয় পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। কুইবেক মূলত ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির আলাদা পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা চাইছিল, কিন্তু আলবার্টা মূলধারার ইংরেজি সংস্কৃতির অংশ হয়েও বিচ্ছিন্নতার কথা বলছে—এটি একটি নতুন প্রবণতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশের ভেতরে প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিরই প্রতিফলন। যেমন—স্পেনের কাতালোনিয়া, যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ড অথবা ভারতের পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলে দেখা গেছে।

---

উপসংহার:
আলবার্টার স্বাধীনতার দাবি এখন আর শুধু একটি প্রান্তিক রাজনৈতিক চিন্তা নয়—এটি মূলধারায় প্রবেশ করছে। কানাডার নেতৃত্বকে এখন প্রয়োজন আরও সংলাপ, আরও আন্তরিকতা এবং আন্তঃপ্রাদেশিক সমঝোতা।
যদি সময়মতো সমস্যাগুলো সমাধান না হয়, তাহলে কানাডার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক একতা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। আলবার্টার এই আন্দোলন হয়তো অচিরেই উত্তর আমেরিকার বৃহৎ রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চলেছে।