২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান—শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়—এর নাম পরিবর্তন করে খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়েছে। সরকারিভাবে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হলে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় বিভিন্ন মহলে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি শুধুই একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংগঠনিক চিন্তাভাবনা। প্রতিবেদনটিতে আমরা বিশদভাবে তুলে ধরছি এই নাম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট, প্রতিক্রিয়া, প্রভাব এবং জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পটভূমি
‘শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবাকে আরও উন্নত ও বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় খুলনা বিভাগের মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে পরিচালিত হয়ে থাকে।
প্রথমদিকে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম অনুসারে নামকরণ করা হয় ‘শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্থ্যখাতে যুগান্তকারী অবদান ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই সম্মান জানিয়ে এই নামকরণ করা হয়।
নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত
২০২৫ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবনা গৃহীত হয় এবং এক মাসের মধ্যে তা কার্যকর করা হয়। নতুন নামটি—খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়—সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছে এবং সকল দাপ্তরিক কাগজপত্রে এই নাম ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “আঞ্চলিক পরিচিতি এবং সাংগঠনিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে করে স্থানীয় জনগণের মাঝে আরও বেশি সম্পৃক্ততা ও গর্ববোধ সৃষ্টি হবে।”
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া
নাম পরিবর্তনের পর খুলনা ও আশেপাশের জেলাগুলোর সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
পক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের মতে:
খুলনা অঞ্চলের মানুষদের জন্য এটি গর্বের বিষয় যে এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি তাদের শহরের নামে পরিচিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনেই এখন মানুষ বুঝতে পারবে এর অবস্থান ও অঞ্চলের পরিচয়।
খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত।
বিপক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের বক্তব্য:
শেখ হাসিনার নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি থাকলে তার ঐতিহাসিক ও জাতীয় মূল্যবোধ রক্ষিত হতো।
এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা ব্যক্তি ও অবদানকে উপেক্ষা করেছে।
নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল উদ্যোক্তার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
প্রশাসনিক ও একাডেমিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে যে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সব ধরনের কার্যক্রম নতুন নাম অনুসারে পরিচালিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বলেন:
“আমরা সরকারের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি এবং সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানাতে চাই, নাম পরিবর্তন হলেও আমাদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক গুণগত মান অপরিবর্তিত থাকবে।”
তিনি আরও জানান, নতুন নামটি দিয়ে নতুন ওয়েবসাইট, পরিচয়পত্র, অফিসিয়াল লেটারহেডসহ সব কিছু দ্রুত হালনাগাদ করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে কিছু গুঞ্জনও লক্ষ্য করা গেছে। সরকার বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতাই মনে করেন, এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ যেটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষাঙ্গন গঠনে সহায়তা করবে।
অন্যদিকে, সরকার সমর্থক মহলের অনেকে মনে করছেন, শেখ হাসিনার নাম একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগ্রত হতো এবং তাঁর অবদানের স্বীকৃতি বহন করত।
শিক্ষার্থীদের মতামত
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা বিভক্তি দেখা গেছে। অনেকে নতুন নামকে সমর্থন করছেন, আবার অনেকে পুরনো নামই রাখতে চেয়েছিলেন।
মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফ বলেন:
“নতুন নাম শুনে ভালো লেগেছে। খুলনার ছাত্র হিসেবে গর্ববোধ করছি।”
অন্যদিকে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী সুমনা বলেন:
“পুরনো নামটি সম্মানজনক ছিল। শেখ হাসিনার মতো একজন নেতার নাম যুক্ত থাকলে তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হতো।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নাম পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু নতুন প্রকল্প ও পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
গবেষণা ল্যাবরেটরি সম্প্রসারণ
ডিজিটাল লাইব্রেরি স্থাপন
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু
ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল পার্টনারশিপ
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি খুলনা বিভাগে একটি প্রধান মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার হিসেবেও গড়ে উঠার পরিকল্পনা নিচ্ছে।
উপসংহার
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুধুমাত্র একটি পরিচয় নয়, এটি বহন করে ইতিহাস, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জনগণের আবেগ। ‘শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ‘খুলনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’-তে পরিবর্তন একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হলেও এর পেছনে রয়েছে বৃহত্তর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
যদিও এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং গবেষণার উন্নয়ন। নাম যাই হোক না কেন, খুলনার এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি আলোকবর্তিকা — সেটিই এখন সকলের প্রত্যাশা।
0 Comments