বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও উত্তপ্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন। ২০২৫ সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে শুরু করেছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতি নিয়ে পৃথক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। এই মতপার্থক্য ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংঘাতকে আরও ঘনীভূত করতে পারে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
আওয়ামী লীগের অবস্থান
আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকেই যথার্থ ও যথেষ্ট বলে মনে করছে। দলটির নেতৃবৃন্দের মতে, সংবিধানের ধারা ১১৮ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন এবং এ পদ্ধতিতে অতীতেও নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন:
“নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে যে প্রক্রিয়া বলা হয়েছে, আমরা সেই প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু দেখি না। সংবিধান অনুসরণ করলেই একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন সম্ভব।”
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতা ও সততার উপর নির্ভর করে, প্রক্রিয়া নয়।
বিএনপির প্রস্তাব ও দাবি
অন্যদিকে, বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম পদ্ধতির দাবি জানিয়েছে। দলটি বলছে, বর্তমান পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি মূলত সরকারি দলের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকায় কমিশন গঠন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন:
“আমরা এমন একটি পদ্ধতি চাই যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সমন্বয় থাকবে এবং কমিশন গঠনে সরকার একচেটিয়া ভূমিকা রাখতে পারবে না।”
বিএনপির প্রস্তাবে রয়েছে:
একটি সর্বদলীয় পরামর্শ ভিত্তিক অনুসন্ধান কমিটি
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন বোর্ড
সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকেও কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার আহ্বান
জনগণের প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষকদের মতামত
নির্বাচন কমিশন একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা থাকলে নির্বাচন মসৃণভাবে সম্পন্ন হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত কমে। কিন্তু বিগত দুই দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জিল্লুর রহমান বলেন:
“কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই সমস্যার সমাধানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক মডেল দরকার, যাতে সব দলের মতামত প্রতিফলিত হয়।”
তরুণ ভোটারদের মধ্যে এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করছেন, “ভোটের আগে কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে গঠন না করা হলে, আরেকটি ‘ভোটের আগের রাতে ভোট’ দেখতে হতে পারে।”
অতীতের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে অতীতে বেশ কয়েকটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচন কমিশন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। অনেক বিরোধী দল কমিশনকে সরকারের ‘অনুগত’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। নির্বাচনের দিন আগেই ভোট বাক্স পূর্ণ হওয়ার অভিযোগ সেই সময় সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হয়ে উঠেছিল।
ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই মুহূর্তে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই মতবিরোধ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কমিশন গঠন নিয়ে যদি একটি সর্বদলীয় সমঝোতা না হয়, তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আরও সহিংসতা, বর্জন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর দৃষ্টি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
উপসংহার
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। আওয়ামী লীগ সংবিধানিক প্রক্রিয়া বজায় রাখার পক্ষে থাকলেও, বিএনপি একটি সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছে। এই মতবিরোধ যদি রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সমাধান না হয়, তবে নির্বাচনী সহিংসতার ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
এখন সময় এসেছে, সব রাজনৈতিক শক্তিকে এক টেবিলে বসে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে ঐক্যমতে পৌঁছানোর।
0 Comments