Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

খুলনার পিকচার প্যালেস মোড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: ৪৪টি দোকান পুড়ে ছাই, ব্যাপক ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা

 


২০২৫ সালের ১৮ মে দিবাগত রাতে খুলনা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকা পিকচার প্যালেস মোড়ের অস্থায়ী বাজারে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক অগ্নিকাণ্ড। এই অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪৪টি দোকান সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন লাগার সঠিক কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, এটি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে ঘটতে পারে। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি এলাকায় চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

আগুন লাগার সময় ও উদ্ধার তৎপরতা:

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় রাত আনুমানিক ২টা ৪৫ মিনিটে। তখন বাজারের দোকানগুলো বন্ধ ছিল এবং রাস্তার আশপাশে খুব একটা মানুষজন ছিল না। হঠাৎ করেই একটি দোকান থেকে আগুনের লেলিহান শিখা উঠতে দেখা যায়। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

খবর পেয়ে খুলনা ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। টানা প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। তবে ততক্ষণে বাজারের অধিকাংশ দোকান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।

ক্ষতির পরিমাণ:

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৪৪টি দোকান পুড়ে গেছে, যার মধ্যে ছিল কাপড়ের দোকান, জুতার দোকান, ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান, কসমেটিকস, স্টেশনারি, ও খাবারের দোকান। দোকানপ্রতি গড়ে কয়েক লক্ষ টাকা করে ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

দোকান মালিকদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে এই বাজারে ব্যবসা করতেন। কেউ নিজের শেষ সম্বল বিনিয়োগ করে দোকান দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন, “আমার সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাড়িতে কী নিয়ে যাব, এখন আমি পথে বসেছি।”

ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া:

স্থানীয় দোকান মালিক সমিতির সভাপতি জানান, “এই বাজারটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতা আসেন। এখানে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন। এই আগুনে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ ও পূনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছি।”

অনেক দোকানি বলেন, তারা কোনোরকমে সংসার চালাতেন। পুঁজির অভাবে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতেন। আগুনে দোকান পুড়ে যাওয়ায় এখন ঋণের কিস্তিও দিতে পারবেন না। এ অবস্থায় সরকারি সহযোগিতা ছাড়া তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।

প্রশাসনের পদক্ষেপ:

ঘটনার পরপরই খুলনার জেলা প্রশাসক ও মেয়র ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা অগ্নিকাণ্ডের কারণ নির্ধারণ করবে এবং ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ হিসাব করবে।

তদন্ত শেষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর পাশাপাশি প্রশাসন পিকচার প্যালেস মোড়ের অস্থায়ী বাজারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার কথাও জানিয়েছে।


ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য:

খুলনা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, বাজারে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। দোকানগুলোর মধ্যে কোনো ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল না এবং বৈদ্যুতিক সংযোগও ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আগুন ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে দোকানগুলোর ঘনত্ব এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাবকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা।

তিনি আরও বলেন, “আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পৌঁছাই, কিন্তু দোকানগুলোর কাঠামো ও দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত।”

মানবিক দিক:

এই অগ্নিকাণ্ডে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই হয়নি, মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শতাধিক পরিবার। একজন দোকানি জানান, “আমার দোকানেই ছিল আমার সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। এখন সব শেষ। ঈদের জন্য কিছু নতুন মালামাল তুলেছিলাম, সব পুড়ে গেছে।”

স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। খাবার, পানি, জরুরি সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। অনেক স্থানীয় বাসিন্দাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

ভবিষ্যতের করণীয়:

এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড রোধে কয়েকটি করণীয় পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে:

অস্থায়ী বাজারগুলোর বৈদ্যুতিক সংযোগ সুরক্ষিত ও নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে।

প্রতিটি দোকানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ও নিরাপদ জোন নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে কীভাবে প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

স্থায়ী বাজার ও শেড নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী দোকান বন্ধ করা যায়।

উপসংহার:

পিকচার প্যালেস মোড়ের এই অগ্নিকাণ্ড খুলনার ব্যবসা জগতে এক বড় ধাক্কা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য এটি একটি বিরাট বিপর্যয়। এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা, পুণর্বাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। একই সঙ্গে নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

Post a Comment

0 Comments