ভূমিকা
গাজা উপত্যকায় আবারও শুরু হয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ব্যাপক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা হামাসের স্থাপনা ও অস্ত্র গুদামে আঘাত হেনেছে। তবে বাস্তবে এর প্রভাব পড়েছে নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর—ধ্বংস হয়েছে আবাসিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবির। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে গোটা গাজা। বিশ্বজুড়ে এই হামলার তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
হামলার পটভূমি
২০২৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে গাজা থেকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে রকেট ছোড়ার অভিযোগে ইসরায়েল পুনরায় বিমান হামলা শুরু করে। তাদের বক্তব্য—এই হামলা ছিল "আত্মরক্ষামূলক"। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি পূর্ব-পরিকল্পিত অভিযান, যেখানে ইসরায়েল গাজার শক্তি ও মনোবল ধ্বংস করতে চায়।
হামলা শুরু হয় রাতের অন্ধকারে। টানা কয়েক ঘণ্টা গাজা শহরের বিভিন্ন অংশে বিমান ও ড্রোন থেকে বিস্ফোরক ফেলা হয়। টার্গেট বলা হলেও, আহত ও নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮৫ জন শিশু ও ৬০ জন নারী রয়েছেন। আহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
একজন চিকিৎসক বলেন:
“আমরা মরদেহ শনাক্ত করতে পারছি না—সব ছাই হয়ে গেছে। শিশুর হাত-পা খুঁজে পাই, শরীর খুঁজে পাই না।”
হাসপাতালের বিপর্যয়
হামলার কারণে গাজার প্রধান হাসপাতালগুলোর অনেকগুলো অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অপারেশন থেমে গেছে, অক্সিজেন সংকটে মৃত্যু হচ্ছে আইসিইউ রোগীদের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানায়,
“গাজায় মানবিক বিপর্যয় দ্রুত গতিতে বাড়ছে। হাসপাতালে ওষুধ, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে।”
শিক্ষা ও আবাসন ধ্বংস
এই হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার বহু স্কুল, মাদ্রাসা এবং শিশুদের খেলার মাঠ। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫০,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়েছে এবং তাদের ঠাঁই হয়েছে অস্থায়ী ত্রাণকেন্দ্রে, যেগুলিও নিরাপদ নয়।
একজন মা বলেন:
“আমার ঘর ছিল না, এখন আমার সন্তানদের আর কোনো ভবিষ্যত নেই।”
ইসরায়েলের যুক্তি ও হামাসের জবাব
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই হামলা ছিল সন্ত্রাসবাদ দমন কার্যক্রমের অংশ। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন:
“আমরা আমাদের নাগরিকদের রক্ষা করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছি। হামাস ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।”
অপরদিকে হামাস জানিয়েছে, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা "প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে"। গাজা থেকে কয়েকটি রকেট ছোড়ার দাবি করে তারা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের বিবৃতি
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন:
“আমি গাজায় সাধারণ মানুষের উপর অব্যাহত সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞে গভীরভাবে মর্মাহত। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছি।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ
যুক্তরাষ্ট্র দ্বিমুখী অবস্থান নিয়েছে। একদিকে তারা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকার করছে, অন্যদিকে "নিরীহ প্রাণহানিতে উদ্বেগ" প্রকাশ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি ও নরওয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের হামলার নিন্দা জানিয়ে গাজায় মানবিক করিডোর চালুর আহ্বান জানানো হয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
তুরস্ক, ইরান, কাতার ও মালয়েশিয়াসহ মুসলিম দেশগুলোর তরফ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন:
“ইসরায়েল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এই অন্যায় রুখতে মুসলিম উম্মাহকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে:
“গাজায় শিশু, নারী ও নিরীহ মানুষের উপর এই বর্বর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতের উচিত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া।”
মানবিক সহায়তা ও প্রতিবন্ধকতা
যদিও আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা গাজায় সহায়তা পাঠাতে চাচ্ছে, তবে সীমান্ত বন্ধ থাকায় প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাফা সীমান্ত (মিশরের সঙ্গে) বন্ধ রয়েছে এবং ইসরায়েল কোনো ধরনের মানবিক ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ
বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #FreeGaza, #SavePalestine ট্রেন্ড করছে। হাজার হাজার মানুষ গাজার ছবিগুলো শেয়ার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বহু দেশে রাস্তায় বিক্ষোভ হয়েছে—বিশেষত যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া ও তুরস্কে।
উপসংহার
গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক এই হামলা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মূল্য চোকাচ্ছে সাধারণ মানুষ। শিশুদের কান্না, মায়ের আর্তনাদ, ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়া মানুষের লাশ—এই দৃশ্য যেন সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একজোট হয়ে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে না এগোবে, তখন এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ বারবার ঘটতে থাকবে। গাজার আজকের কান্না যেন বিশ্বের বিবেককে জাগিয়ে তোলে।
0 Comments