Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক চা দিবস উদযাপন



 ভূমিকা

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় পানীয় চা। এটি শুধু একটি পানীয় নয়, বরং একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি এবং কূটনীতির সম্পর্ক। জাতিসংঘ প্রতিবছর ২১ মে ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে, এবং ২০২৫ সালের এই দিনটি ছিল আরও বৃহৎ আকারে এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে উদযাপন করা হয়েছে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে। এই উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল—চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অবদানকে সম্মান জানানো, পরিবেশবান্ধব চা উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।


 আন্তর্জাতিক চা দিবসের ইতিহাস

আন্তর্জাতিক চা দিবস প্রথম পালিত হয় ২০০৫ সালে ভারতের দিল্লি ও শ্রীলঙ্কায়। পরবর্তীতে চা উৎপাদক দেশগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ২০১৯ সালে ২১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০২০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন শুরু হয়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এই দিবসটির তত্ত্বাবধান করে এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক চা শিল্পের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।


 ২০২৫ সালের উদযাপন: অনুষ্ঠান ও আলোচনা

এই বছরের চা দিবস উদযাপন ছিল বেশ আড়ম্বরপূর্ণ ও অর্থবহ। জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেয় চা উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক দেশসমূহের কূটনৈতিক প্রতিনিধি, গবেষক, খাদ্য বিশেষজ্ঞ, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং পরিবেশবাদী সংগঠন।

আলোচ্য বিষয়:

টেকসই কৃষিপদ্ধতি: চা উৎপাদনে কীভাবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও জৈব সার ব্যবহার করা যায়।শ্রমিক অধিকার: চা বাগানে কর্মরত নারী ও শিশুশ্রম প্রতিরোধ এবং তাদের জীবনমান উন্নয়ন।

বাজার ও ন্যায্য মূল্য: উন্নয়নশীল দেশের চাষিরা যেন চা বিক্রির প্রকৃত মূল্য পায় তা নিশ্চিত করা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: চা উৎপাদনে জলবায়ুর প্রভাব এবং অভিযোজন কৌশল নিয়ে আলোচনা।


বিশেষ অতিথি ও বক্তব্য

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক, ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি, চীন, কেনিয়া, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা। তারা তাদের নিজ নিজ দেশের চা শিল্পের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

ভারতের প্রতিনিধি বলেন:

“চা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চা উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ। আমরা টেকসই পদ্ধতিতে চা উৎপাদন নিশ্চিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছি।”

বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেন:

“বাংলাদেশের চা বাগানে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। আমরা চা শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং বাগান শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছি।”



 বৈশ্বিক চা শিল্পের চিত্র

বর্তমানে প্রায় ৬০টি দেশে চা উৎপাদিত হয় এবং চা শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ যুক্ত। চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া হচ্ছে বিশ্বের প্রধান চা উৎপাদক দেশ।

বৈশ্বিক চা উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ:

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈরী আবহাওয়া

শ্রমিকদের কম মজুরি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

কৃষিজমির সংকট

আন্তর্জাতিক বাজারে দামের অস্থিরতা


 চা ও সংস্কৃতি

চা কেবল একটি পণ্য নয়, বরং এটি বহু জাতি ও সভ্যতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চীনের চা সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। জাপানে চা-অনুষ্ঠান (Tea Ceremony) একটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চর্চা। ভারতে চায়ের দোকান বা ‘চায়ের ঠেক’ সামাজিক মিলনের কেন্দ্র। বাংলাদেশেও চা শুধু পানীয় নয়, আতিথেয়তার প্রতীক।

জাতিসংঘে আয়োজিত প্রদর্শনীতে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী চা পদ্ধতি, পাত্র ও পরিবেশন উপস্থাপন করা হয়, যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।


 পরিবেশবান্ধব চা উৎপাদনের গুরুত্ব

বিশ্বজুড়ে চা উৎপাদনকারীরা এখন জলবায়ু সচেতন। রাসায়নিক সার কমানো, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, জৈব চা উৎপাদন এবং পানির সঠিক ব্যবহার নিয়ে এখন সচেতনতা গড়ে উঠছে।

FAO-র মতে,

“চা উৎপাদন যেন পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে পরিচালিত হয়, সেটাই আজকের সময়ের চাহিদা।”


 শ্রমিকদের অবস্থান

চা শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি হলো বাগান শ্রমিকরা। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র, স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে আসা। জাতিসংঘের এই দিবসের মাধ্যমে তাদের দাবি ও সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা হয়েছে।


 বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৯০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে। সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় চা বাগান রয়েছে। বর্তমানে জৈব চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

চা বোর্ডের উদ্যোগ:

বাগান শ্রমিকদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প

চা রপ্তানি বাড়াতে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ

জৈব চা সার্টিফিকেশন কর্মসূচি


 উপসংহার

আন্তর্জাতিক চা দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি উপলক্ষ—যেখানে পৃথিবীজুড়ে চা সংশ্লিষ্ট মানুষের জীবনের কথা বলা হয়। জাতিসংঘের এ উদযাপন বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এই পণ্যটির পেছনে শ্রম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীর সংযোগ রয়েছে।

আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই দিবসের মধ্য দিয়ে চা শিল্পে টেকসই উন্নয়ন, শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার এবং পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতির প্রসার ঘটবে।

Post a Comment

0 Comments