বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে আবারও এক করুণ ঘটনার সাক্ষী হলো জাতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম শাম্মো (Shahriar Alam Shammo) নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর পুরো শিক্ষাঙ্গনে বয়ে গেছে শোক, ক্ষোভ এবং বিক্ষোভের ঝড়। শিক্ষার্থীরা শুধু ক্ষোভ জানিয়ে থেমে থাকেনি, বরং তাঁরা রাস্তায় নেমে সরকারের নীরবতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পটভূমি
১৮ মে ২০২৫, ঢাকার মালিবাগ এলাকার একটি হোস্টেলে গভীর রাতে শাম্মোর রুম থেকে তাঁর নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। প্রথমে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা। মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন, নাক ও মুখে রক্ত, এবং ঘরে তছনছ অবস্থার প্রমাণ ঘটনাটিকে আত্মহত্যা নয়, বরং নির্মম হত্যাকাণ্ড বলে তুলে ধরে।
শাম্মোর পরিচিতি ও ছাত্রজীবন
শাম্মো শুধু একজন সাধারণ শিক্ষার্থী ছিলেন না। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে তাঁর ব্যাচের অন্যতম মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিতর্ক, সামাজিক আন্দোলন, এবং বিভিন্ন ছাত্র-সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। তাঁর বন্ধু, শিক্ষক এবং সহপাঠীরা তাঁকে একজন বিনয়ী, যুক্তিবাদী এবং মানবিক ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
হত্যার পর শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
শাম্মোর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে আসে রাজপথে। শিক্ষার্থীরা শুরুতে মোমবাতি প্রজ্বলন এবং নীরব মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানালেও প্রশাসনের নীরবতা ও ‘আত্মহত্যা’ হিসেবে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টায় ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
প্রধান দাবিসমূহ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি এবং রাজু ভাস্কর্যে গণসমাবেশের মাধ্যমে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন:
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শাম্মোর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনা।
বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেল ও আশেপাশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর যেকোনো হামলার বিচার।
শিক্ষকদের অবস্থান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষকরা ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, "একজন শিক্ষার্থীর প্রাণহানি শুধু পরিবার বা বিভাগের ক্ষতি নয়, এটি পুরো শিক্ষাঙ্গনের ব্যর্থতা।"
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, গণমাধ্যম ও শিক্ষার্থীদের লাগাতার চাপের মুখে তদন্তের আশ্বাস দেয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি তদন্তাধীন এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
বেশ কিছু রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনও এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনগুলোও নিন্দা জানালেও তারা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন না তোলায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
অপরদিকে, বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো এই হত্যাকাণ্ডকে সরকারের ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করছে এবং বলছে, "এটি ছাত্রসমাজকে ভয়ভীতির মধ্যে রেখে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের একটি প্রচেষ্টা হতে পারে।"
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
শাম্মোর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য পোস্ট, ভিডিও এবং প্রতিবাদ। #JusticeForShammo ট্রেন্ড করে দেশজুড়ে। অনেকে তাঁকে "শিক্ষার্থীর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে চাওয়া ষড়যন্ত্রের বলি" বলে আখ্যায়িত করছেন।
অতীতের সঙ্গে সংযোগ
এটি প্রথম নয় যখন শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ উঠেছে। আবু বকর, আবরার ফাহাদ, ত্বকী – তাঁদের মতোই শাম্মো যেন আরেকটি নাম হয়ে না যায় শুধুই একদিনের হেডলাইন। শিক্ষার্থীরা এই হত্যাকাণ্ডকে ‘সিস্টেমেটিক সাইলেন্সিং’ এর অংশ হিসেবেও দেখছেন।
ভবিষ্যতের পথ
বিশ্লেষকরা বলছেন, শাম্মোর মতো একজন মেধাবী ছাত্রের হত্যাকাণ্ড যদি পার পেয়ে যায়, তাহলে শিক্ষাঙ্গন নিরাপদ থাকতে পারে না। এই ঘটনায় ছাত্রসমাজের ঐক্য, প্রতিবাদ, এবং সোচ্চার ভূমিকা ভবিষ্যতে এমন অন্যায় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকার ও প্রশাসনের উচিত হবে স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। অন্যথায় ছাত্রসমাজের ক্ষোভ সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে।
উপসংহার
শাহরিয়ার আলম শাম্মোর হত্যাকাণ্ড আমাদের কাঁদিয়েছে, কিন্তু এটি আমাদের ঘুম ভাঙাতেও বাধ্য করেছে। আজকের ছাত্রসমাজ কেবল পড়ালেখায় নয়, সমাজবদলের দাবিতেও সোচ্চার হচ্ছে – যার প্রতিফলন আমরা শাম্মোর হত্যার প্রতিবাদে দেখতে পাচ্ছি। এখন সময় এসেছে প্রশাসনের সদিচ্ছা দেখানোর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতার প্রমাণ রাখার।
0 Comments