Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু: অবহেলা ও অবকাঠামোগত সংকটের মর্মান্তিক পরিণতি

 


ভূমিকা

বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব এক দীর্ঘদিনের সমস্যা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ সমস্যা অনেক সময় প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনই এক করুণ ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের উত্তর মোল্লাপাড়া গ্রামে। রোববার, ২০২৫ সালের ১ জুন, সন্ধ্যার দিকে জমে থাকা বৃষ্টির পানির গর্তে পড়ে গিয়ে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

এই ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি আমাদের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, এবং শিশুদের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতার ঘাটতির একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।


ঘটনাস্থল ও পরিবেশ

উত্তর মোল্লাপাড়া একটি ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম। গ্রামের রাস্তাগুলো কাঁচা এবং কিছু কিছু স্থানে উন্নয়ন কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গর্তে পানি জমে গেছে। যেখানে এই দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে, সেটি একটি পরিত্যক্ত উন্নয়ন প্রকল্পের খোঁড়া গর্ত ছিল। রাস্তার পাশেই ছিল সেই গর্তটি, যা ভারী বৃষ্টির ফলে পানিতে পূর্ণ হয়ে ছোট একটি পুকুরে রূপ নেয়।

গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, এই গর্তটি দীর্ঘদিন ধরে খোলা ছিল এবং এর চারপাশে কোনো ধরনের সতর্কতা চিহ্ন, বেড়া বা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছিল না।


নিহত শিশুর পরিচয়

নিহত দুই শিশু হলো:

  1. নাবিলা আক্তার (৭) – স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

  2. তাসফিয়া ইসলাম (৬) – একই স্কুলে শিশু শ্রেণির ছাত্রী।

তারা পরস্পরের খেলার সাথী ও প্রতিবেশী ছিল। ঘটনার সময় তারা রাস্তায় খেলা করছিল এবং সেই সময়ই পাশের গর্তে পড়ে যায়। এলাকাবাসী অনেকক্ষণ পর খোঁজাখুঁজি করে দুই শিশুকে পানি থেকে উদ্ধার করে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।


প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুল হোসেন জানান,

“আমরা যখন শুনি দুইটা মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। পরে সেই গর্তে দেখি পানিতে কিছু ভাসছে। তখনই সন্দেহ হয়। দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নিই, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।”


পরিবারগুলোর শোক ও ক্ষোভ

নিহত শিশুদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাবা-মায়ের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল। নাবিলার মা বিলাপ করে বলেন,

“আমার মেয়ে তো একটু আগেও খেলা করতেছিল… এভাবে চলে যাবে ভাবি নাই।”

তাসফিয়ার বাবা অভিযোগ করেন,

“এই গর্তের বিষয়ে আমরা ইউপি সদস্যদের বহুবার জানিয়েছি। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আমার মেয়ে নেই, কে দায় নেবে?”


স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

ঘটনার পরপরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু করা হয়। মারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,

“ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। আমরা তদন্ত করে দেখছি কে বা কারা অবহেলা করেছে। ভবিষ্যতে যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান,

“শিশু মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করছি। উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা পরিবারকে সহযোগিতা করবো।”


দায় কার?

এই ঘটনায় সরাসরি দায় পড়ছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও ইউনিয়ন পরিষদের উপর। একটি গর্ত, যেটি পানি জমে ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে, সেটিকে খোলা রেখে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা — এটি চরম উদাসীনতা।

প্রত্যেকটি উন্নয়ন প্রকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ এখানে কোনো সাইনবোর্ড, বেড়া বা আলোকসজ্জা ছিল না।


সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতার অভাব

এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কেবল প্রশাসন নয়, সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। স্থানীয়রা যদি সময়মতো ব্যবস্থা নিতেন, প্রতিবাদ করতেন বা নিজেরাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতেন — হয়তো এই শিশুরা বাঁচতো।

শিশুদের নিরাপদ খেলাধুলার জায়গার অভাব এবং জনসচেতনতার অভাবে এমন মৃত্যুর হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।


ভবিষ্যতের করণীয়

অবিলম্বে উন্মুক্ত গর্তগুলো বন্ধ বা নিরাপদ করা।
স্থানীয় সরকারকে আরও দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।
শিশুদের জন্য নিরাপদ খেলার মাঠ নিশ্চিত করা।
সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে স্থানীয়ভাবে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা।
দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে প্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা ও সতর্কতা চিহ্ন বসানো।


উপসংহার

কিশোরগঞ্জের উত্তর মোল্লাপাড়ায় দুই নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু আমাদের সমাজের অব্যবস্থা ও অবহেলার করুণ চিত্র। এই মৃত্যুগুলো দুর্ঘটনা হলেও প্রতিরোধযোগ্য ছিল। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু সরকারের কাজ নয় — এটি আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব।

প্রতিটি শিশুর প্রাণ অমূল্য। তাই আর কোনো শিশু যেন এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর শিকার না হয় — সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

Post a Comment

0 Comments